রঘুরাজপুর —- কথাকলি ঘোষ

রঘুরাজপুর
কথাকলি ঘোষ

“তুমি কেমন করে গান কর যে,গুনী,
অবাক হয়ে শুনি কেবল শুনি।”

প্রতিদিন এই ভুবনমাঝে শ্রুত,অশ্রুত কত গান গীত হয়ে চলেছে।এই সুরের সুরধুনীর স্পর্শ পেলাম সেদিন ঊড়িষ্যার রঘুরাজপুর গ্রামে পদার্পণ করে। অবাক হয়ে শুধু গুনীজনের সৃষ্টিকে প্রত্যক্ষ করলাম।
ভুবনেশ্বর থেকে যাত্রা শুরু করে পুরী যাবার ১৪কিমি আগে এই গ্রাম।২০০০ সালে ঊড়িষ্যার এই গ্রাম কে ন্যাশনাল হেরিটেজ ভিলেজ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।গ্রামটিতে ১৪০জন পরিবারের বাস। প্রতিটি বাড়ীর অন্দরে রয়েছে অসীম সৌন্দর্যের খনি,প্রতিটি দেওয়াল নানা উজ্জ্বল রং এ সজ্জিত।প্রতিটি পরিবার এই হস্তশিল্পের সঙ্গে ই যুক্ত।নানা মহাভারতের, রামায়ণের কাহিনী, পৌরাণিক কাহিনী, বিভিন্ন। দেবদেবীর মূর্তি,হাতের নিপুণ তুলিতে মূর্ত্ত হয়ে উঠেছে।আর প্রভু জগন্নাথদেব বিশেষ প্রাধান্য লাভ করেন তাদের অঙ্কনশৈলী তে। তালপাতার উপর তাদের অপূর্ব হস্তশিল্প দেখে ইতিহাসের পাতায় মন চলে যায়। নৃত্যের নানা বিভঙ্গ ও ফুটে ওঠে তুলিতে।নৃত্যগুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের জন্ম ও এই গ্রামে।


সর্বোপরি পটচিত্রের এক মায়াবী জগতের সন্ধান পেতে যেতেই হবে এই গ্রামে।পট্ট অর্থাৎ বস্ত্রের উপর চিত্ররা কথা বলে কবির ভাষাতে।
আর এক বৈশিষ্ট্য হল তারা ব্যবহার করে শুধু প্রাকৃতিক রঙ।প্রদীপের কালি থেকে কালো, শাঁখের গুঁড়া থেকে সাদা রং,পাথরের গুঁড়ো থেকে অন্যান্য রং। তেঁতুলের বীজ থেকে তৈরী করে আঠা।নারকেল,সুপারী,কৌটো,পাতা, সব ই অনন্যসুন্দর হয়ে ওঠে তাদের হাতের ছোঁয়ায়।
ইতিহাস বলে ৮০০বছর আগে জন্ম এই গ্রামের।প্রভু জগন্নাথদেব এর মন্দির নির্মাণে কিছু শিল্পী যুক্ত হয়েছিলেন। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রাজা নরসিংহদেব শিল্পীদের কাজে খুশী হয়ে ৪০জন শিল্পীর এই গ্রামে বসবাসের ব্যবস্থা করেছিলেন।পরে আরো ১০০পরিবার এসে বসবাস শুরু করেন।


গ্রামের মানুষের আন্তরিকতা,সহজ,সরল জীবনযাত্রা মনকে স্পর্শ করে যায়।সুন্দর সৃষ্টির স্রষ্টা তো সূন্দর ই হবে,বলাই বাহুল্য। সঞ্চয়ের ঝুলি সমৃদ্ধ করার জন্য কয়েকটি সৃষ্টিকে তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করলাম।অপার আনন্দ, ভালো লাগা নিয়ে আবার যাত্রা করলাম পুরীর দিকে। সমুদ্রের হাতছানি,প্রভুর অমোঘ আকর্ষণের মাঝেও মনের গভীরে স্থান করে নিল রঘুরাজপুরের শৈল্পিক সৌন্দর্য। জীবনের ধন ভান্ডারে সঞ্চিত হল আর একটি অমূল্য ধন।
“যে গান কানে যায় না শোনা
সে গান যেথায় নিত্য বাজে
প্রাণের বীণা নিয়ে যাব
সেই অতলের সভামাঝে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *