“ছুটি” মৌসুমী লাহিড়ী

বিভাগ : গল্প
“ছুটি”
মৌসুমী লাহিড়ী

রোশনি আজ অফিসে একটু দেরি করেই এসেছে। ব্যাগটা কাঁধ থেকে টেবিলে নামিয়ে রেখে চেয়ারে চুপ করে বসে রয়েছে অনেকক্ষন। চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছে যেন সারা রাত ঘুমোয়নি। “ম্যাডাম, চা, না কফি?” রোশনি কোনো উত্তর দিচ্ছে না। “ম্যাডাম…” “ওহ, রাজু? তুমি আমাকে একটু ঠান্ডা জল এনে দিতে পারো? চা, কফি কিছু খাবো না।” “ঠিক আছে ম্যাডাম, এখুনি আনছি।” রাজু ঠান্ডা জলের বোতল এনে দেয়। রোশনি এক গ্লাস জল খেয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে একটু জল দিয়ে আসে। টেবিলে রাখা ফাইল খুলে দেখতে থাকে। না আজ তার কাজে একটুও মন লাগছে না। ভীষণ অন্যমনস্ক রয়েছে।

তুতুনের তাহলে কি হবে? ওর যত্ন, লেখাপড়া, বড়ো হওয়া? মা ছাড়া তো ওর আর কেউ নেই। বাবা তো থেকেও নেই। বছর খানেক হলো তুতুনের বাবা সৌমেন তার পি এ এর সঙ্গে লিভ টুগেদার করে। আর কিছু ভাবতে পারছে না রোশনি। কাল থেকে চিন্তা করে ওর দুচোখের পাতা এক হয়নি। কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। কাল রাতে ওর মা ফোন করেছিল, কিন্তু ইচ্ছে করে ও ধরেনি। কি কথা বলবে মায়ের সঙ্গে? এই ভেবে সে কথা বলেনি।

অনন্যা রোশনির টেবিলে এসে জিজ্ঞাসা করে, “লাঞ্চ এ যাবি কখন? আড়াইটে বেজে গেল?” রোশনি যে ফাইলটা দেখছিল অনন্যা আসতেই সেটা বন্ধ করে ফেলে। ও বলে, “আজ আমার খিদে নেই রে অনন্যা। তুই খেয়ে আয়। কিছু মনে করিস না, প্লিজ।” রোশনি আর অনন্যা একইদিনে এই কোম্পানিতে জয়েন করেছিল। প্রায় দশ বছর ধরে একসঙ্গে আছে। দুজনই একে অপরকে খুব ভালো বোঝে। রোশনির মেয়ে তুতুন আর অনন্যার মেয়ে সৃষ্টি দুজনে একই স্কুলে পড়ে।

“ম্যাডাম, ডিরেক্টর সাহেব লাঞ্চের পরে আপনাকে একবার ডেকেছেন।” রাজু বলে চলে যায়। রোশনি লাঞ্চ ব্রেকের পর ডিরেক্টর মিঃ সেনগুপ্তর ঘরে যায়। “মে আই কাম ইন স্যার?” “ইয়েস কাম ইন। রোশনি, আমাদের নতুন প্রজেক্ট রেডি হয়ে গেছে। আপনাকে এই ইউনিটের সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। এটা আপনার প্রমোশনও বলতে পারেন।” রোশনি বলে, “স্যার আমার কদিন ছুটির প্রয়োজন।” মিঃ সেনগুপ্ত বলেন, “আজ 25th জুন। 1st জুলাই থেকে আপনার ইউনিট ওপেন হচ্ছে। এই সময় তো ছুটি দেওয়া সম্ভব না। আপনি কয়েকটা দিন পরেই ছুটিটা নেবেন।” রোশনি বলে, “কিন্তু স্যার, আমার মুম্বাই যাওয়ার টিকিট কাটা হয়ে গেছে…” মিঃ সেনগুপ্ত এবার বলেন, “কোনো কিন্তু নয়, মুম্বাই পরে গেলেও চলবে।” “ঠিক আছে স্যার।” এই বলে রোশনি ফিরে আসে নিজের টেবিলে। প্রমোশনের সংবাদ শুনে রোশনি আরও চিন্তায় পড়ে গেল।

Ist জুলাই। রোশনির নতুন ইউনিট এর দায়িত্বভার নিতে যাওয়ার কথা। অফিস থেকে বার বার কল আসে রোশনির ফোনে। এতবার ফোন করা সত্বেও কেউ রিসিভ করেনি। ওর ফোনে মেসেজ আসে “রোশনি আজ আপনি এত লেট করছেন। সবাই অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।” রোশনির মতো দায়িত্বশীল মহিলার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ডিরেক্টর অনন্যা ও আরেকজন স্টাফকে রোশনির বাড়িতে পাঠান।

রাজু ডিরেক্টরের ঘরের পর্দা সরিয়ে বলে, “ভিতরে আসবো স্যার?” “এসো রাজু”। “স্যার, রোশনি ম্যাডাম এই ফাইলটা গতকাল একজন লোককে দিয়ে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। একটা চিঠিও দিয়েছেন।” “দাও আমাকে” রাজু। “আমাকে এত বড়ো দায়িত্বভার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ স্যার। অফিসের নতুন ইউনিটের ইনগুরেসনের ফাইলটা পাঠালাম। নতুন ইউনিটের জন্য শুভ কামনা রইলো। রোশনি।”

অনন্যা রোশনির বাড়িতে এসে দেখে বিছানায় রোশনি চিরনিদ্রায় শায়িত। ওর মাথার কাছে তুতুন বসে কাঁদছে। অনন্যা প্রথমটা কিছু বুঝতেই পারছিল না। তারপর “রোশনি! …. ” বলে জোরে কেঁদে ওঠে। নিজেকে একটু সামলে নেওয়ার পরে পাশের টেবিলে একটা ফাইল চোখে পরে অনন্যার। “কার্সিনোমা? ম্যালিগন্যান্সি? এডভান্সড স্টেজ! অনন্যা হতবাক হয়ে টেবিলের পাশে বসে পড়ে। টেবিলে টাটা মেডিকেল সেন্টার এ যাওয়ার জন্য মুম্বাইয়ের ফ্লাইটের টিকিটটাও পড়ে রয়েছে। “রোশনি তুই আমাকে সব কথা বলতিস, আর তোর ক্যানসার হয়েছে এটা বলতে পারলি না।” অনন্যা অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে তুতুনকে বুকে জড়িয়ে ধরে। অনন্যা প্রথমে ফোন ক’রে রোশনির বিধবা মাকে জানায়। তারপর অফিসে। “স্যার, রোশনি আর কোনওদিন অফিসে যাবে না। রোশনি ছুটি নিয়ে চলে গেছে অনেক দূরে। শেষ ছুটি।”

* * * সমাপ্ত * * *

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *