শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব আমন্ত্রণে — কোয়েলী ঘোষ

শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব আমন্ত্রণে
কোয়েলী ঘোষ

প্রতি ঋতুতেই সেজে ওঠে শান্তিনিকেতন । শৈশব থেকেই ফুলে ফুলে সাজিখানি কখন ভরে উঠেছে , ফুলে ফুলে রঙে রঙে সেজে ওঠে প্রিয় শান্তিনিকেতন ।
এখানে এলে শুধুই বেড়ানো নয় , এক অন্য অনুভব । মাটি ডাক দেয় কোন অতলে আর সেই প্রাণের টানে রাঙা মাটির পথ ধরে চলো , যতটুকু ঝুলিতে আনন্দ ভরে নিয়ে যাওয়া যায় ।

” ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগলো যে দোল ”
হলুদ বরণ শাড়ি পরে ওরা চলেছে । প্রথমে ছোটরা তারপর বড়রা , বাজছে খোল করতাল । হাতে বাজছে মন্দিরা , কাঠি নৃত্য ।
এরপর আশ্রম পরিক্রমা শেষে বসন্তের গান গুলো একে একে গাওয়া হয় মঞ্চে আর অপূর্ব সম্মিলিত নাচ দেখে মন ভরে ওঠে ।
সব শেষে ” রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে ” .. গানের শেষে আবীর ওড়ে ।
” রঙ যেন মোর মর্মে লাগে
আমার সকল কর্মে লাগে ”
মানুষের সাথে মানুষের , প্রকৃতির এক নিবিড় যোগ ঘটে এই উৎসবে ।
হোলি উৎসব এখানে পালিত হয় না । এখানে মনের সাথে রঙের উৎসব , মিলন উৎসব ।

১৯০৭ সালের ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, শান্তিনিকেতনে
বসন্ত শ্রীপঞ্চমীতে গুরুদেবের ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুরু করেন এই উৎসব ।
ষোলো বছর পর কবিপুত্রের মৃত্যুর পর আবার এই উৎসব শুরু হয় ।
কবি নিজেও এই উৎসবে উপস্থিত থাকতেন । গানে ও কবিতায় অংশ নিতেন । তিনি বসে থাকতেন আলপনা আঁকা বেদীতে । সব শেষে তাঁর পায়ে আবীর দিয়ে প্রণাম ।
‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে ”
১৯৪০ সালের ২৭ মার্চ কবি শেষবার সকালের বসন্তোৎসবে উপস্থিত থাকতে পেরেছিলেন ।

দুধারে শামলনিবিড় গাছের ছায়া , শালবীথি ,তাল, তমাল্ কদম ফুলের দীর্ঘ বন ,থরে থরে পলাশ শিমুল , অশোক ফুটে আছে ।
কনকচাঁপা ,রঙ্গণ ,কাঞ্চন , লাল সাদা ফুল , পথ কখনো লাল , কখনো বা গৈরিক । ফুল ঝরে পড়েছে গাছের তলায় , মুগ্ধ নয়নে চাই , ”আমি কি গান গাব যে ভেবে না পাই ”–
ফেলে এসেছি কতটা পথ ,এসেছি তোমার মন্দিরে । এখানে সুর ভেসে যায় .. গান ভেসে যায় …

কবির বিশাল সাম্রাজ্য মাঝে ছড়ান আছে শিল্পকীর্তি ,গান , কবিতা । আছেন নন্দলাল বসু ,রামকিঙ্কর বেইজের হাতের স্পর্শ –যেদিকে তাকাই অবাক হয়ে যাই । রবির কিরণমাখা প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালে মনে হয় –কতটুকু জানি ! কত কি রয়ে গেল অধরা ।
বিশ্বভারতী ছুঁয়ে চলেছি কোপাই নদীর কাছে ।”ও যে আমায় ঘরের বাহির করে পায়ে পায়ে পায়ে ধরে —
ও যে কেড়ে আমায় নিয়ে যায় রে , যায় রে কোন চুলায় রে –”
আমার সাতকুল ভাসানো মন রাঙামাটির পথে ভাসায় ভেলা –দিনান্তবেলা । ভেতর বার করে এক অদ্ভুত উল্লাস ,জিজ্ঞাসা । রাস্তার দুধারে আকাশমণি , শিশু ,ইউক্যালিপটাস , নিম , অর্জুন ,শাল , মহুয়া –রাঢ় ভূমিতে ছড়ানো আছে অন্য এক সৌন্দর্য । ‘ দুহাত বাড়িয়ে কাছে ডাকে ।

পেরিয়ে এলাম আদিবাসী সাঁওতাল গ্রাম , লাল গিরিমাটি দিয়ে আঁকা অঙ্গণ ।পরিচ্ছন্ন পরিপাটি নিকানো উঠোন । স্মৃতি বড় টানে –নিয়ে যায় অতীতে –” সেইখানেতে সাদায় কালোয় মিলে গেছে আঁধার আলোয় / সেইখানেতে ঢেউ ছুটেছে এ পারে ওই পারে ——-স্বপন -সাথে জড়িয়ে জাগা , কাঁদি আকুলধারে ”।।
মন হারিয়ে গেছে –কোথায় ? সোনাঝুরির শাল মহুয়ার জঙ্গলে ,কেউ খোয়াইয়ের পথে । হাট বসেছে শনিবারে ,গাছের তলে । ওরা পসরা সাজিয়ে বসে । ডোকরার গয়না , বীজের মালা , কানের দুল , খেসের শাড়ি্ , বাটিক ,ফেব্রিক , কাঁথা স্টিচ , পাটের তৈরি জিনিস …..
গাছের নিচে বাউল তখন একতারায় সুর তুলেছে ।

ট্রেন উঠেছে দুলে ,আমার মন গিয়েছে চুরি , ভাল থেকো সোনাঝুরি , আমার সাধের শান্তিনিকেতন ,ভাল থেকো আউল বাউলের দল । বাঁচিয়ে রেখো শিল্প , তোমার যত নিদর্শন ।

ভাল থেকো আমার দেশের মাটি , এই মিলনস্থল ,এই আশ্রম প্রাঙ্গণ । আমার স্বপ্নের বড় প্রিয় শান্তিনিকেতন । নির্জনতার একাত্মতার শান্তি যেন বিঘ্নিত না হয় ।
——————

এখানে আসার জন্য অনেক ট্রেন আছে । শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস , বিশ্বভারতী , ইন্টারসিটি । থাকার জন্য অনেক লজ , হোটেল , গেস্ট হাউস আছে ।
একটি টোটো ভাড়া করে দেখে নিতে পারেন পুরো শান্তিনিকেতন । আমার কুটির , সৃজনী শিল্প গ্রাম , সোনাঝুরির বন , কোপাই নদী তীর , কঙ্কালিতলা , প্রকৃতি ভবন , সাঁওতালি গ্রাম , শ্রী নিকেতন , রায়পুর রাজবাড়ি ইত্যাদি ।
=========

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *