পশ্চিম সিকিম ভ্রমণ পর্ব – ২ কোয়েলীর সাথে পেলিং
পশ্চিম সিকিম ভ্রমণ পর্ব – ২
কোয়েলীর সাথে পেলিং
মন্দারিন ভিলেজে চারটি ঘর বুক করা ছিল ।সেখানে জিনিসপত্র রেখে পরদা সরাতেই দেখি লাল আবীরের রঙে সূর্য পাহাড়ের বুকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ।
ঘরে ঘরে এসে গেল লেবু চা । চায়ের স্বাদ অপূর্ব ।আশা কেক আর মিষ্টি বানিয়ে এনেছিল । সবাই মিলে বসে আড্ডা আর খাওয়া হল । এতটা পথ পেরিয়ে এসে সবাই বেশ ক্লান্ত ছিলাম। রাতের খাবারের অর্ডার ঘরে এসে দুটি মেয়ে নিয়ে গেল আবার কিছুক্ষণ পর ঘরে ঘরে পৌঁছে দিল ।
সন্ধ্যের পর ঠাণ্ডা বোঝা গেল । ঘরে ঘরে রুম হিটার এলো তবুও হাড় কাঁপানো শীত ।দুটো কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম ।
সেই শান্ত নিঝুম গ্রামে , সবুজ গহন অরণ্যে , রাত্রি নামল ।দূরে পাহাড়ের গায়ে গায়ে বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলে উঠল যেন অন্ধকারে কেউ প্রদীপ জ্বালিয়েছে ।
কাঞ্চনজঙ্ঘার মুখোমুখি
পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙতেই গায়ে চাদর জড়িয়ে বাইরে এলাম । যতদূর দৃষ্টি যায় ধূসর ,নীল পাহাড় প্রথমে লাল তারপর রুপোর মত ঝলমল করে উঠল । সেই শান্ত ,সৌম্য পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে মনে হয় ,তুমি সুন্দর । সেই সুন্দরের কাছে এলে মন কি পবিত্র ,স্নিগ্ধ হয়ে যায় ।চারিদিকে ঘন সবুজ , পাখির কুজন -ঘুম ভাঙছে কালুক গ্রামের ।এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নির্জন অনুভবে দিন কাটিয়ে দেওয়া যায় । আরও পরে ঝলমলে রোদে ভরে গেল সারা আকাশ । মনে হল এখানেই স্বর্গ ।
পেলিং
ঘরে ফিরে স্নান সেরে সোয়েটার ,জ্যাকেট ,টুপি পরে সবাই প্রস্তুত হলাম । আলুর পরোটা ,লুচি আলুর দম , মোমো , চা –ডাইনিং হলে বসে নিজেদের অর্ডার মত সবাই খেয়ে নিলাম ।
মনে পড়ল আজ নেতাজির জন্মদিন । চারিদিকে সুন্দর ফুল । মনে মনে তাঁকে পাহাড়িয়া ফুলে অঞ্জলি দিলাম ।
ততক্ষণে বড় ভাড়া গাড়ি এসে হাজির । ছোট বাচ্চা নিয়ে আমরা ন জন গাড়িতে এসে বসতেই যাত্রা শুরু হল পেলিং এর উদ্দেশ্যে ।
পেলিং পশ্চিম সিকিমের এক জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র । উচ্চতা ৬,৮০০ ফুট । গাড়ি চলেছে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে নিচে খাদ , চারিদিকে সবুজ পাহাড়ের ঢেউ , মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি ।
গাড়ি এসে দাঁড়াল পথের ধারে । বাইরে বেরিয়ে দেখি পাথরের ধাপে ধাপে ঝর্ণা নেমেছে উচ্ছ্বল কিশোরীর মত । রাস্তা পার হয়ে পাহাড় থেকে গড়িয়ে চলেছে চলেছে কোথায় জানা নেই । ছবি তুলে রাখলাম । গাড়ি আবার চলতে শুরু করল । এর নাম ছাঙ্গে ফলস ।
পাহাড়িয়া ঝোরা , পাইন , বাঁশ , বেত বন পেরিয়ে চলে এলাম সাঙ্গাচেলিং মনাস্ট্রি । এবার পায়ে হাঁটা পথ ।
গাড়ি থেকে নামার পর খাড়াই এত বেশি যে হেঁটে যেতে হয় । কষ্ট করে অনেকটা হাঁটার পর বিশাল মূর্তি দেখা গেল । ১৩৭ ফুট উঁচু চেনরেজিগ এর মূর্তি যেটি সিকিমের মূর্তি গুলির মধ্যে উচ্চতায় চতুর্থ । ১৬৯৭ সালে নির্মিত এই মনাস্ট্রি সিকিমের দ্বিতীয় প্রাচীন মনাস্ট্রি । সম্প্রতি গ্লাস – স্কাই ওয়াক টি এর আকর্ষণ বাড়িয়েছে । ভারতে এই উচ্চতায় এরকম কাঁচের স্কাই ওয়াক এই প্রথম ।
১০০ টাকার টিকিট কেটে আমরা ওপরে উঠলাম ।
বাইরে নানা বুদ্ধমূর্তি দিয়ে সাজানো চত্বর । অব লোকিতেশ্বর আর নানা বুদ্ধ মূর্তি ।
এখান থেকে যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূর কাঞ্চনজঙ্ঘা আর নানা শৃঙ্গ , উপত্যকা , বিস্তৃত পাহাড় , ধূসর , নীল , সবুজ , তার ওপর মেঘ ভেসে যায় । সামনে সিঁড়ি দিয়ে উঠে মন্দির । মন্দিরের ভিতরে পদ্ম সম্ভব ও শাক্য মুনি বুদ্ধের সুন্দর মূর্তি আছে । ভেতরে চন্দনের গন্ধ আর অপূর্ব শান্ত পরিবেশ ।
খুব ধীরে বাজছে ” বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি ” … শান্ত মনে বসি কিছুক্ষণ পদতলে ।
সামনে স্কাইওয়াক মানে আকাশপথে হাঁটা । পুরো ব্রিজ কাঁচের তৈরি । সেই ব্রিজ থেকে ওপরে আকাশ , পাহাড় , নিচের দিকে তলদেশ অবধি দেখা যায় । বেশ রোমাঞ্চকর অনুভূতি , বেশ ভয়ের । মনে হবে পায়ের নিচে কিছু নেই ।
পেলিং এ দুপুরের খাওয়ার জন্য একটা রেস্টুরেন্ট এ গাড়ি দাঁড়াল । এখানে সব খাবার পাওয়া যায় । সোহিনীর জন্য এলো থুকপা । একটা কাঁচের বাটিতে ভাসমান নুডলস্ , বিট , গাজর সবজি সহযোগে । বাচ্চারা চিকেন মোমো খেতেই পছন্দ করল । বাকিরা ফ্রায়েড রাইস , চাওমিন ইত্যাদি যে যার পছন্দ মতো খেয়ে বাইরে এলাম । এক সিকিম মহিলার দোকান থেকে কেউ কেউ কিছু উপহার দেবার জন্য কিনলো । সুন্দর কারুকাজের কাপ ডিস , লাফিং বুদ্ধ , শীতের সোয়েটার ইত্যাদি কিন্তু জিনিসের দাম অন্য জায়গার থেকে বেশি । এবার আবার গাড়িতে উঠলাম ।
আবার চলা শুরু । এবার যাবো সিংশোর ব্রিজ । দূর থেকে ব্রিজ দেখা গেল । দেখলে মনে পড়বে হরিদ্বারের লছমনঝুলা ।
ব্রিজের ওপর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম । দুদিকে খাদ , পাহাড় , সবুজ গহন জঙ্গল । বাঁদিকে কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে নদী ।
ব্রিজের মুখে ছোট দুটো দোকান । সিকিমের দুজন সুন্দরী মেয়ে দোকান চালায় । ওরা খুব সুন্দর আদা দিয়ে চা বানিয়ে খাওয়াল ।
বিকেল গড়িয়ে এলো । চারিদিকে ঘন কুয়াশা , মেঘ । আমরা ফিরে আসছি আমাদের শান্ত নির্জন কালুক রিসর্টে ।
ছবি – সায়নী ও সোহিনী ।
পরের সংখ্যায় সমাপ্ত ।