জয়দেব কেন্দুলির মেলায় কোয়েলীর সাথে
জয়দেব কেন্দুলির মেলায় কোয়েলীর সাথে
অনন্তকাল যেন এই লাল মাটির পথে পথ চলা। জনসমুদ্র জোয়ারে ভাসে কবি জয়দেবের বাউল মেলা। এখন মানুষ দেখি , মানুষ — শুধুই চলেছে মানুষ । কাতারে কাতারে চলেছে মকরসংক্রান্তির পুণ্য লগ্নে স্নান করে ধন্য করবে জীবন।
আমরা চলেছি কবিমেলায় , কবি জয়দেবের জন্মভূমি, পূণ্যভূমি সেই জয়দেব , কেন্দুলিতে — আলোর বেণু পত্রিকার সম্পাদিকা রীণা কবিরাজ দিদির আহ্বানে। এই দিনে সকাল থেকে মেলায় কবির আসর বসে , নানা প্রান্ত থেকে কত কবিরা আসেন , কত পত্রিকা ,বই প্রকাশিত হয়। কবিতায় , গানে ভরে ওঠে ভক্তিভবন।
পেরিয়ে এলাম হলুদ বরণ সরষে ক্ষেত । অপরূপা এই বাংলা মায়ের মুখ । তারপর কত প্রান্তর , প্রাচীন গাছ , নবীন বন সৃজন ,দুহাত মেলে দিয়েছে আকাশে । শীতের কুয়াশা গেছে কেটে ,এখন চারিদিকে আলো ঝলমল রোদ।
অজয়ের তীরে জমে উঠেছে মেলা । কেউ যাবে মেলায় ,কেউ ভোরে স্নান সেরে ঘরে ফেরে ।মুখে পরিতৃপ্তির ছাপ , মনে পরম বিশ্বাস । হাতে ঘর গৃহস্থালির জিনিস ,বাচ্চার খেলনা । কত দোকান পাট ,কত শিল্পীর হাতের কাজ ,পাটের ব্যাগ ,বাউল ,বাউলানী ,বর বউ ,বেতের বোনা ধামা ,কুলো , মাটির সরা ,হাঁড়ি , একতারা , মাটিতে পথের ধারে ধারে সাজানো।
বীরভুমের মাটিতে বয়ে চেলেছে ভক্তিরসের ধারা — অজয় নদীর উত্তর -তীরবর্তী গ্রাম কেন্দুবিল্ব বা কেন্দুলি গ্রাম ।অজয়ের কুলকুল ধ্বনির মধ্যে মিশে আছে গীতগোবিন্দ কাব্যরস ,ভগবত প্রেমে মাতোয়ারা কবি জয়দেব আর স্ত্রী পদ্মাবতীর কাহিনী ।
পৌষ সংক্রান্তিতে বসেছে মেলা ।সারি সারি তাবুর ভিতরে বেজে উঠেছে ডুবকি ,তাপ্পি দেওয়া আলখাল্লা পরা আউল বাউলের দল ,ফকির সম্প্রদায় ।
বিশাল প্রান্তর জুড়ে তাঁবু খাটানো । আছে নানা আশ্রম , সাধু সন্ন্যাসীদের আখড়া ।
”জয় গৌর ”জয় নিতাই ” সাদর আহ্বান –খড়ের ওপর চাদর পাতা ।হাড়কাঁপুনি ঠাণ্ডায় দাঁতে দাঁতে ঠকঠকে আওয়াজ । আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে শুনছি বাউল গান । আপন ভাবে মাতোয়ারা বাউল ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে গাইছে , পায়ে ঘুঙুর বাজছে ঝমঝম হাতে একতারা । কি ভাবে বিভোর তারা । এই পৃথিবীর বাইরে যেন এক অন্য জগত । সুর পৌঁছে যাচ্ছে ঊর্ধ্বলোকে ,তারপর নামছে সারা শরীর জুড়ে এক আনন্দ -শিহরণ !
”আমি কোথায় পাবো তারে আমার মনের মানুষ যে রে –” যুগ হতে যুগান্ত যেন সেই অন্বেষণ —
”তারে ধরি ধরি মনে করি ধরতে গিয়ে আর পেলেম না — দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচাসোনা ” —
এই জয়দেবের মেলায় মূল আকর্ষণ বাউল আর কীর্তন গান । সারারাত মূল মঞ্চে আর প্রায় তিনশো আখড়ায় গান শোনা যায় ।
কবি জয়দেব আর গীত গোবিন্দ কাব্য কথা
”রাত্রিশেষে উঠি মঙ্গল -আরতি করিয়া
প্রাতঃকালে সুকুসুম আনেন তুলিয়া
পদ্মাবতী নানা রঙ্গে গাঁথে ফুলহার
গীতগোবিন্দ রচে প্রভু কৃষ্ণ- লীলা সার ।”
গীতগোবিন্দ কাব্য লিখতে বসেছেন কবি জয়দেব । ”স্মর গরল খণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং ” –এখানে এসে থেমে গেলেন । কবি ভাবছেন —
”কৃষ্ণ চাহে পাদপদ্ম মস্তকে ধরিতে
কেমনে লিখিব ইহা বিস্ময় এই চিত্তে ”
কবি গ্রন্থ রেখে স্নানে গেলেন । গঙ্গাদেবী বলিলেন –বছরের তিনদিন আমি অজয়ে তোমার জন্য মিশে থাকব । কবির বিশ্বাসের জন্য শাঁখাপরা দুটি হাত তুলে দেখাবেন কদমখণ্ডীর ঘাটে । কবি আনন্দে আত্মহারা হয়ে অবগাহণ করলেন ।
এদিকে নারায়ণ কবি জয়দেবের রূপ ধরে এসে উপস্থিত হলেন গৃহদ্বারে । পদ্মাবতী পা ধুইয়ে অন্ন পরিবেশন করলেন । শ্রীকৃষ্ণ আহার শেষ করে পালঙ্কে বসে ”গীতগোবিন্দ ‘ কাব্য খুলে স্বহস্তে লিখলেন — ”দেহি পদপল্লব মুদারম ” ।তারপর শয়ন করলেন । পদ্মাবতী পা টিপে দিলেন তারপর সেই প্রসাদ গ্রহণ করতে বসেছেন এমন সময় স্নান সেরে জয়দেব ফিরলেন ।
তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন — এখনও আমি রাধামাধবের ভোগ নিবেদন করিনি । তুমি কেন আজ আগেই খেতে বসেছ ?
পদ্মাদেবী ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ে সব কথা বললেন । তাঁর স্বামীর বেশ ধরে তবে কে এলেন ঘরে ? শয়ন ঘরে কেউ নেই । জয়দেব ব্যগ্র হয়ে পুঁথি খুলে দেখলেন – যে পদ অসম্পূর্ণ ছিল তা সম্পূর্ণ হয়েছে ।
কবি জয়দেব আনন্দে নৃত্য করতে লাগলেন ,মুখে ” হরি ‘ হরি’ নাম দুচোখে দরদর অশ্রু । কবি যেন বাহ্যজ্ঞান হারালেন । তারপর পদ্মার স্তব করে বললেন — তুমি মহাভাগ্যবতী , তাই শ্রীকৃষ্ণের ভোজন করিয়ে ,চরণ স্পর্শ করলে । তারপর দুজনে সেই প্রসাদ গ্রহণ করতে লাগলেন ।
পৌষ সংক্রান্তির ব্রাক্ষমুহূর্ত লোকে লোকারণ্য । জয়ধ্বনিতে মুখরিত অজয় কিনারে হাজার হাজার মানুষ ।
” হেনকালে দুই বাহু শঙ্খ উত্তোলন
কদম্বখণ্ডীর ঘাটে দিলা দরশন ।।”
হরি হরি ধ্বনি উঠল । ভক্তির জোয়ারে ভেসে গেল শত শত ফুল —
অতীতের সেই সাক্ষী নিয়ে দাঁড়িয়ে রাধা বিনোদ মন্দির । ১৬৮৩ সালে বর্ধমানের মহারাজা কীর্তি চাঁদ এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । নয়টি চূড়া বিশিষ্ট এই মন্দিরের দেওয়ালে বিষ্ণুর দশ অবতার আর রামায়ণের চিত্র আঁকা আছে । ভেতরে রাধা গোবিন্দ । পায়েস প্রসাদ পাতায় দেওয়া হচ্ছে । এই বিশ্বাস আর আস্থায় লক্ষাধিক ভক্তরা আসেন এখানে । স্নান সেরে এই মন্দিরে পুজো দেন ।
হরিদাস আশ্রমে আমরা যখন গেলাম তখন দেবতার পুজো চলছে । জীবন যেন ধূপের মত সৌরভ ছড়িয়ে নিঃশেষ হতে চায় । সেই বাঁশি বাজে আজো এই আখড়া ,এই ভক্ত কবি কুমুদকিঙ্করের আশ্রমে । এই আশ্রমে সকালে মুড়ি , চপ ,বোঁদে দিয়ে জলখাবার , দুপুরে পাত পেড়ে নিকানো মাটিতে প্রসাদ খেলাম । অপূর্ব সেই স্বাদ ।
বাঁশিওয়ালা ,কোন সুরে সুরটি তোমার সাধা
চিরবিরহিণী ,প্রেমময়ী দাঁড়িয়ে আছে রাধা ।
তোমার দরজায় কোন ভেদাভেদ নেই । ধনী ,দরিদ্র সবার একসাথে মাটিতে বসে সবাই ভোগ খায় । তিনদিন ধরে চলে অন্নসত্র । কার অন্ন ,কেই বা খাওয়ায় ? জানতে হলে আসতে হয় , বার বার প্রণত হতে হয় । সেই কৃষ্ণবরণ মূর্তিখানি ছবির মত আঁকা ।
বারবার ফিরে ফিরে তুমি নাই বা দেখা দিলে
আঁকা আছে সেই মুখ ,হৃদয় যেখানে মেলে ।
এইখানে আমার প্রিয়জন ,প্রিয়মুখ । এইখানে শ্যামল বনের ছায়া মাখা শৈশব ,আলোমাখা রোদ , স্নেহ মাখা কণ্ঠস্বর , সব পিছনে ফেলে আসি । স্মৃতি তবু বার বার টানে সেই এক উঠোন ,এক দাওয়ায় ।
কানে বাজে গান — ”এমন মানব জনম আর কি হবে / মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে ” ……………
এই মাটির গান শুনতে এখানে আসতে হবে । এই পথের ধুলো গায়ে মেখে হাঁটতে হবে সবার সাথে পা মিলিয়ে । এই অনুভব আর উপলব্ধি একেবারে আলাদা ।
কাছাকাছি দেখে নেবেন ইছাই ঘোষের দেউল , বক্রেশ্বর , দুবরাজপুরের পাহাড়েশ্বর ,হেতমপুরের রাজবাড়ি ,জঙ্গল , টেরাকোটার মন্দির , ঠাকুর সত্যানন্দ দেবের স্মৃতিধন্য রামকৃষ্ণ আশ্রম , বক্রেশ্বর ড্যাম , বীরভূমের পাঁচটি সতীপীঠ ,শক্তিপীঠ তারাপীঠ আর কবিগুরুর শান্তিনিকেতন , শ্রীনিকেতন ।
পথ নির্দেশিকা — ময়ূরাক্ষী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার বা হুল এক্সপ্রেসে দুবরাজপুরে নামতে পারেন । থাকার জায়গা আছে । সেখান থেকে গাড়িতে আসতে পারেন ।
যে কোন ট্রেনে আসতে পারেন বোলপুর ,দুর্গাপুর , বা পানাগড় । সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে আসতে হবে ।
কলকাতা থেকে টানা গাড়ি করে আসতে পারেন । ইলামবাজার থেকে সোজা যে রাস্তা বক্রেশ্বরের দিকে চলে গেছে সেদিকে এসে জয়দেব মোড় পড়বে । বাঁদিকে ঢুকে যেতে হবে ।
সবখান থেকেই বাস পাওয়া যায় । অন্যসময় বাসে আসা যায় কিন্তু পৌষ সংক্রান্তির দিন বিশাল ভিড়ের জন্য বাসে ওঠা যায় না ।