করুণা ভক্তি আর সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি শ্রীচৈতন্য এবং সাহিত্যের জগতে তাঁর ভাবধারার প্রবেশ

করুণা ভক্তি আর সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি শ্রীচৈতন্য
এবং সাহিত্যের জগতে তাঁর ভাবধারার প্রবেশ: শিরনাম

মধ্যযুগের এক ক্রান্তিলগ্নে মহাপ্রভুর শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব,
সেই সময়ে দেশ এক রাজনৈতিক অশান্তি ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে চলছিলো,সেই সময় তিনি সমস্ত ধর্মের সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে এক সর্বমানবিক প্রেমধর্ম প্রচার করেন,
জীবে দয়া,ঈশ্বরে ভক্তি আর সংকীর্তন এই ত্রিবিধ আদর্শের উপর চৈতন্যধর্ম প্রতিষ্ঠিত ।

তাঁর আবির্ভাবে বাঙালী জাতির চিত্ত ,জড়ত্বের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে,স্বচ্ছ ও বেগবতী ধারায়,সমাজ জীবনকে,নানা দিক থেকে বিচিত্রমুখী বিকাশের দিকে নিয়ে যায়।
মুসলিম শাসনে প্রায় আড়াইশত বছর সমাজ বিপর্যস্ত ছিলো, ব্রাহ্মণ সমাজের আদর্শনিষ্ঠা লুপ্ত হয়েছিলো,
তিনি বিরাট সাম্য সংস্থাপনের আদর্শে বাংলা তথা ভারতবর্ষকে দীক্ষিত করলেন,
রবীন্দ্রনাথের উক্তিতে,
“আমাদের বাঙালীর মধ্য হইতেই তো চৈতন্যদেবের উদয় হইয়াছিলো,তিনি তো বিঘা কি কাঠার মধ্যে বাস করিতেন না, তিনি বিস্তৃত মানবপ্রেমে বঙ্গভূমিকে জ্যোতির্ময়ী করিয়া তুলিয়াছ্লেন।”

সাহিত্য তো সমাজের দর্পণ,যে কোন সময়ের সাহিত্য পাঠ করলে সেই সময়ের জীবনযাত্রা রাজনৈতিক, সামাজিক , মানসিকতার পূর্ণ পরিচয় পরিলক্ষিত হয়।
যেমন যুদ্ধকালীন বা যুদ্ধপরবর্তী বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিকের রচনা আমাদের সেই সমাজের কষ্ট যন্ত্রণার পূর্ণচিত্র অনুভব করতে পারি ঠিক সেভাবেই দেখি ধর্ম প্রচার অথবা ধর্মের রকমফের কিভাবে সেযুগের সাহিত্য কে পরিপুষ্ট করে।

ধর্ম ও সাহিত্যের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে,সে সম্পর্ক
গূঢ়গভীর ও অতলস্পর্শী,ধর্ম
সাহিত্যের একটি বড় উপাদান।মানুষের বোধ-বিশ্বাস,চিন্ত -চেতনার ইতিবাচক দিকসমূহই হলো সাহিত্যের প্রধান প্রতিপাদ্য।

তাঁর আবির্ভাবে শুধু সমাজ জীবন নয় বাংলা সাহিত্যেও ঋতু পরিবর্তন হলো,তাঁরই প্রভাবে মধ্যযুগের দেবমুখীসাহিত্যে মানবতন্ত্রী মনোভাব প্রাধান্য পেলো।

চৈতন্যপূর্ব বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যর লৌকিক প্রেমানুভূতিই ছিলো প্রধান ,চৈতন্যদেবের প্রভাবে গোবিন্দ দাস,জ্ঞানদাস,বলরাম দাস,নরহরিপর চক্রবর্তি ,নরোত্তম দাস প্রমুখ কবিরা পদাবলী সাহিত্যর মানবকল্যাণ ও ভক্তি ভাবুকতার মুক্তবেণী রচনা করলেন।
তাঁকে নিয়ে ‘গৌরচন্দ্রিকা’ বিষয়ক পৃথক রসপর্যায় সৃষ্টি হয়।

চৈতন্য প্রভাবে মঙ্গলকাব্যোর কবিরাও বিষ্ণুপদ রচনা শুরু করেন,
অন্যদিকে বৈষ্ণবপাবলীর আদর্শে
স্বাতন্ত্র গীতিকাব্য শাক্ত পদাবলীর উদ্ভব ঘটে,বাউল সঙ্গীতেও অল্পবিস্তর চৈতন্য প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
অনুবাদ সাহিত্যও চৈতন্যপ্রভাব কম নয়,

রামায়ণ মহাভারতের চৈতন্য পরবর্তী সময়ে অনুবাদ সাহিত্যে দেখা যায় ,পরিবেশ, চরিত্র এবং কাব্যরসের ওপর চৈতন্যের প্রভাব যথেষ্ঠ, কাশীরাম দাসও বৈষ্ণব ভক্ত ছিলেন, সুতরাং তাঁর লিখিত পুস্তকে নিশ্চিতভাবেই,
চৈতন্যভাবধারা বিরাজিত ।

কবি মধুসূদন এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ
বৈষ্ণব ভাবাবেগে অণুপ্রাণিত হয়েছিলেন তাঁদের রচনায় তা সুন্দরভাবে পরিস্ফুট, তারই প্রমাণ
‘ব্রজাঙ্গণা ‘এবং ‘ভানুসিংহের পদাবলী’।

রবীন্দ্রনাথের কথায়,
“স্বয়ং সাহিত্যিক না হয়েও এবং পার্থিব জীবন বহন না করলেও ভাবোন্মদকতাময় বিপুল পদসাহিত্যের প্রেরণাদাতা এবং যাবতীয় সামাজিক অসাম্যের ঘোর প্রতিবাদী ছিলেন।মধ্যযুগীয় দেবমুখী সাহিত্য মানবতন্ত্রী মনোভাব প্রাধান্য পেলো”।

“বর্ষাঋতুব মতো মানুষের সমাজে,এমন একটা সময় আসে,যখন হাওয়ায় মধ্যে ভাবের বাষ্প প্রচুর পরিমাণে বিতরণ করিতে থাকে,চৈতন্যের পর বাংলাদেশের সেই অবস্থা আসিয়াছিলো। তখন সমস্ত আকাশ মেঘের রসসিক্ত ছিলো। তাইসে সময় যেখানে যত কবি মন মাথা তুলিয়া দাঁডাইয়াছিলো, সকলেই সেই রস গ্রহণ করিয়া কত অপূর্ব ভাষা এবং নতুন ছন্দে, কত প্রাচুর্য এবং প্রবলতায় তাহাকে দিকে দিকে বর্ষণ করিয়াছিলো।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *