পত্রলিপি **২ –#শ্বেতা_ব্যানার্জী

পত্রলিপি **২
প্রিয় অনি,

তুই এখনো আমার খুবই প্রিয় ——
“”আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে”
হ্যাঁ,ঠিক এইভাবেই তুই শুরু করলি—
আমি বললাম, এই ভরা পৌষে মিলনমেলার মাঠে
তুই কোথায় পেলি আষাঢ়ের প্রথম দিন!!
দ্যাখ, চোখ থাকলেও মনের সঙ্গে যদি তার পরিচয় না করাস কোনদিন তুই কাব্যিক পরমানন্দের আনন্দ নিতে পারবিনা।
তাই বুঝি!? হ্যাঁ ম্যাডাম,
তাহলে বলুন পরমানন্দ….
আকাশে মেঘের অপূর্ব ঘনঘটা দেখে কবির মনে যে কাব্যিক প্রেম জেগেছিল —-
তার থেকেই তো সৃষ্টি মহাকবি কালিদাসের “মেঘদূত ” কাব্য। যেখানে জীবনের আবেদন চিরায়ত , তা কোনদিন পুরনো হতে পারেনা।
কবিগুরু “মেঘদূতের” রূপকার্থ বিশ্লেষণে এই মহৎ
সৃষ্টকে মানুষের চির বিরহবেদনার প্রতিচ্ছবি হিসাবে দেখেছেন। কী করে একজনের বেদনাবোধ সার্বজনীন হয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ “মেঘদূত “…..

আমি তোর কথা থামিয়ে দিয়ে বলি,মন্দক্রান্তা ছন্দ
শেখাবি বলেছিলিস,
তুই বললি, ঠিক আছে কাল তোদের বাড়ি গিয়ে শেখিয়ে দেবো।
………কালবৈশাখীর ঝড়ের মতন ঘরে ঢুকেই বলে উঠলি নিয়ে আয় খাতা কলম, মোটা মাথায় কিছু যদি হয়।

আমি মনযোগী হয়ে পড়লাম….
তারপর চেষ্টা করলাম — মন্দক্রান্তা ছন্দে লেখার–

মনের হাসি ফুরাইয়া গেলে অধর হারায় হাসি
বেদন গাথা বাজিল যে মনে বাজিবে কী আর বাঁশি
কোথা পাইবো সেই মেঘদূতে পাইবো কী পত্রখানি
বিরহানলে জ্বলিয়া মরিনু গলেতে দিবো গো ফাঁসি

অলকাপুরে আমি যে একাকী বিরহিণী যক্ষ প্রিয়া
মেঘ প্রত্যাশী বিরহীকাজরী আকুলিত মোর হিয়া
অশ্রুসজল বিরহ বেদনা প্রোষিতভর্তৃকা আমি
তব মঙ্গলে সাজাইয়া দীপ জ্বালাই মঙ্গল দিয়া

তুই বলে উঠলি…
মন্দক্রান্তা ছন্দ কোথায়!! কোথা রাখি এ কালিদাসে!!
আমি নীরবে চোখের জল ফেলি.…আর তুইই হো, হো, হাসিতে আকাশ কাঁপাস—-
বলিস,চোখের জল মুছিসনা বাষ্প হতে দে, ওরাই তোর মেঘদূত হয়ে আমার কাছে তোর চিঠি পৌঁছে দেবে। তুই হ’বি লেডি যক্ষ—–
আমি বলি কেন!!তুই তো… তবে!!
ধর, কোন এক ভুলে যদি সাজা পেয়ে চলে যেতে হয়—
আমি মুখ চেপে ধরে বলি,চুপচুপ এমন বলিসনা–
তবে তুই যদি অসীমের মাঝে ডানা মেলে উড়ে যেতে চাস, বা শঙখচিলের দেশে,
তোর ডানায় আমার প্রাণের স্পন্দন লাগিয়ে দিয়ে মুক্তকরে দেবো, খাঁচায় বন্দী না রেখে।

তুই বললি দ্যাখ, রাগিস না।
বিরহ না থাকলে প্রেমের আধার নৈঋতে বাসা বাঁধে।

মানে!?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৃত্যনাট্য ‘শাপমোচনে’
উঠে আসে অরুণেশ্বর ও কমলিকার প্রেম-বিরহের ঘটনাপ্রবাহ।
আমি বলে উঠি — ” জ্বলে উঠুক আলো আভরণ যাক ঘুচে”

কথার মাঝে কথা নয়, কী বলছি শোন।

আবার–
কর্তব্যে অবহেলার জন্য এক প্রেমিক যক্ষ অভিশপ্ত হয়ে এক বছরের জন্য পত্নী বিরহিত জীবন যাপন করতে রামগিরি আশ্রমে নির্বাসিত হয়। তখন প্রিয়া সান্নিধ্যে বঞ্চিত তার হৃদয়….।

ওডিসিয়াস এবং পেনেলোপ(গ্রীক অন্যান্য প্রেমের গল্পের মতন এই জুটির প্রেমেও ছিল ত্যাগ আর বিসর্জন। আসলে প্রেমের ক্ষেত্রে ক্ষেত্রফল হ’লো বিয়োগ ও যোগের খেলা।
“Tragedy and Sacrifice ” এই হ’লো মূলমন্ত্র।
যেমন এই জুটি মিলনের জন্য অপেক্ষা করেছিল
দীর্ঘ কুড়ি বছর।

এই যে তিনটি গল্প এর প্রেক্ষপট আলাদা, লেখক আলাদা কিন্তু মিল একজায়গায়।
ট্রাজেডি —-
তবে তিনটে নয় তিনহাজার হয়তো আছে ট্রাজেডি গল্প। আমি তোকে তিনটে দিয়েই উদাহরণ দিলাম।

ট্রাজেডি ছাড়া প্রেম সার্থক হয়না।
আমি বলি, কেন!! অরুনেশ্বর আর কমলিকার মিলন তো হয়েছিল।
হ্যাঁ হয়েছিল,তবে অনেক বিয়োগান্ত অধ্যায় পার করে..।
বিষাদের ছোঁয়া অনেকটা ঠিক বিদ্যুত স্পৃষ্ঠের মতন। মানুষের মনে অনেক স্তর থাকে, সেই স্তরে কোন কথা কতটা ডিঙিয়ে কতটা আঘাত করবে মানুষই বোঝেনা। বিষাদ যেন একটা স্রোত, একটা ধারা যা যুগ যুগ ধরে বয়ে চলে অন্তঃসলিলা হয়ে…
আর সেই স্রোত যখন উন্মুক্ত হয়ে উন্মাদ হয়ে উঠে
তখনই জন্ম প্রকৃত রোমান্টিকতার—কখনো
আবার বিষাদও , যেমন মোনালিসার হাসি। ক’জন বুঝি এই হাসির মানে! ক’জন বুঝি কোনারকের মূর্তির হাসির রহস্য। বিষাদের আভাস আর প্রেমের আত্মালাভ, যেন নিঃসঙ্গ এক বাঁশির ধ্বনি…
শ্রীমতীকে খুঁজে চলা…
আর বিরহ!?
সে তো ভেসে থাকা এক তরঙ্গ, যেন চৈতন্যের প্রতিভূ। মাটিতে পা না রেখেও সচেতনভাবে আঁচড়ে চলে হৃদয়ের জমিতে। শেষের কথাগুলো একদম ঠিক বলেছিস, আমি বেঁচে আছি উদভ্রান্ত উদ্বাস্তুর মতন।
শোন, লা রুশফুকো বলেছিলেন যে মানুষ যদি প্রেমের কথা এত না শুনতো তাহ’লে সে প্রেমে পড়তো না।যা সাহিত্যে নেই তা নেই জীবনে।
সাহিত্যের রসদই জীবনে অনুভূত হয় বা জীবনের রসদ সাহিত্যে।
আর বিষণ্ণ হওয়া, মানুষের জীবনের একটা সুস্থ লক্ষণ।
তুই তো তার বাইরে নয়। আত্মকরুণা নয় আত্মপরীক্ষা ও আত্মশোধন। আত্মসমর্পণ করা নিছক বিনোদন। আমার অন্তত তা-ই মনে হয়।
” What man has made of man” তাই নিয়ে ভেবে লাভ নেই। আসল হলো আমি নিজে কী করছি।
আজ সারাদিন ধরে কথাগুলো নাড়াচাড়া করে, শুধু তোকে বোঝবার চেষ্টা করেছি….
না পারিনি, আমি অধিকার চাইনি,আর তুই দায়িত্ব। আজ ফাটলের নয়নজুলি নয়নের জলে জ্বলজ্বল করে.—

“Sacrifice everything for a friend but never sacrifice a friend for anything ”
হ্যাঁ, এই কোটেশন আমার মুখস্থ হয়ে গেছে—-
এই কথাগুলো তুই কতবার বলেছিলিস,আর আজ তুই বন্ধুকে ভুলে গেলি, কিন্তু কারণ অজানা।

তবুও রাত নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় কারণ সে আমার একা থাকার মানে বোঝে…।
হে রূপসী বিষাদময়ী রাত, তুমি বয়ে আনো এই রাতের সমার্থক শব্দ…. তোমার সৌন্দর্যের স্ফুলিঙ্গে বিষাদেও থাকুক প্রেমের পূর্ণতা….

আজ আকাশের দিকে চেয়ে—-
William Wordsworth একটা কবিতার কয়েকটা লাইন খুব খুব মনে পড়ছে —

For oft, when on my couch I lie

In vacant or in pensive mood,

They flash upon that inward eye

Which is the bliss of solitude;

And then my heart with pleasure fills,

And dances with the daffodils.
——————- ইতি
———————- মৃণালিনী

#শ্বেতা_ব্যানার্জী
৩,১,২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *