জ্যোৎস্না ফুঁড়ে i20 —- গল্প / গীতশ্রী সিনহা

জ্যোৎস্না ফুঁড়ে i20

গল্প / গীতশ্রী সিনহা

——- একটা নদীর নাম বলো ?
——- কুন্তি !
——- একটা পাখির নাম বলো?
——- নীলকন্ঠ !
——- একটা দ্বীপের নাম বলো এবার ?
——- হুঁ হুঁ সবুজদ্বীপ !
—— না না হলো না… অন্য কোনো নাম বলো
প্লিজ !
—— কেন ? মনে ধরলো না নামটা ?
—— না, তা ঠিক না! দ্বীপ তো সবুজ হয়…অন্য
কোনো নাম বলো?
——- আমার মনে আসছে না যে ! তুমি বলো !
——- ধরো যদি হয়… মানস দ্বীপ ! কেমন নাম? চলবে তো?
——- উফ চলবে মানে ! দৌঁড়াবে গো ! নাইস নাম।
——- দুজনে হাঁটছে, মেঠো পথ ধরে, পাশাপাশি, মাথার উপর গোল চাঁদ আশকারা দিয়ে চলেছে, আঁকাবাঁকা পথ সরু হয়ে গেছে… কাছাকাছি দুজনে…
——- চাঁদটা দেখেছো ? হর্ষা চাঁদটা দেখায়।
——- হুঁ!
——- শুধু হুঁ ! আর কিছু না !
——- বারে… কি বলব?
——- চাঁদটার কথা ! ভালো না ?
——- ভালো। তবে যদি ফুলতে ফুলতে ফেটে যায়, তখন ?
——- তাহলে আরও ভালো ! জ্যোৎস্নার প্লাবনে ভেসে যাবে সব ! আর আমরাও…
——– হর্ষার গলায় গাঢ আবেশ ! স্বপ্ন ভাসছে দুচোখের পাতায়। বেহাগ টের পায়। বেহাগের অন্যরকম লাগে হর্ষা কে। বেহাগের খুব মিষ্টি লাগে হর্ষা কে, যেন সুগার ফ্রি কিউবের মতো মিষ্টি, বলতে ইচ্ছে হয়, হর্ষা তুমি চাতক তৃষ্ণায় কাতর মাটির বুকে প্রথম বৃষ্টি। ভেজা মাটি ঘ্রাণের মতো তুমি সুন্দর।

——- কথা বলো কিছু ! চুপ কেন বেহাগ ! হর্ষা তাকিয়ে থাকে বেহাগের দিকে। লম্বা ফর্সা বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, মাথায় একরাশ ঘন কালো চুল… কপালে নেমে এসেছে, পাজামা পাঞ্জাবি, কাঁধে ঢাউস ব্যাগ।
——- ভাবছি, কোথা থেকে শুরু করি !
——- তোমার তো কখনো কথার অসুখ হয় না বেহাগ ! ঝরনার মতো ঝরঝর করে বয়ে যাও ! তুমি ঝরনা হও বেহাগ !
——- যথা আজ্ঞা দেবী। তাহলে সেইভাবেই শুরু করি হর্ষা …
——- বলো?
——- তুমি তো আমার কাছে কিছু চাইলে না ?
——- বলো কি চাইবো?
——- ঐ তিনটি জিনিসের মধ্যে একটা… নীলকন্ঠ পাখি, কুন্তি নদী কিংবা মানস দ্বীপ।
——- চাইলে দেবে ?
——- আলবাৎ ! চেয়েই দেখো !
——- সত্যি দেবে ? ধরো যদি চাই মানস দ্বীপ ?
——- নাও দিলাম ! বেহাগ এমনভাবে বললো যেন দ্বীপের সে রাজা।
——- রিনরিন করে হাসতে থাকে হর্ষা, বেহাগের বলার ধরন দেখে। হাসির শব্দে ফিরে তাকায় বেহাগ। খুব কাছটিতে হর্ষা। শ্যামলা একটা মিষ্টি মেয়ে, চুলের ঢল নেমেছে পিঠ বেয়ে নদীর মতো। কপালের টিপে লেগে আছে যেন শিল্পচ্ছটা। দুচোখে ভাসে স্বপ্ন, সারা মুখে জ্যোৎস্না ছড়ানো। শীতের পড়ন্ত বিকেলে মাথায় আলতো করে ঘোমটার মতো আঁচলের অন্যমনস্ক আবরণ… বেহাগের চোখে আইডিয়াল বাঙালি বউ।
——– এই রে একটা ভুল হয়ে গেল ! হর্ষার চাহুনিতে প্রশ্ন চিহ্ন।
——– কি আবার ভুল হলো ?
——– দ্বীপটা তো নিলাম ! জানা হলো না তো দ্বীপ টা কেমন ?
——- ভয় নেই তোমার হর্ষা, ভারি সুন্দর দ্বীপ । সবুজ… অনেক গাছ , প্রচুর আলো, টাটকা বাতাস, পাখিদের গুঞ্জন, ফুলে ফলে গন্ধমাখা হাজারো প্রজাপতির ঘর উঠান, খেলার বন্ধু হবো আমরাও। দ্বীপের নদীর জলে ভাসানোর জন্য আছে একটা শালতি।
——- আর ? আর কিছু নেই ?
——- আছে, অনেক কিছু আছে সেই দ্বীপে, মুখের কাছে মুখ নামিয়ে বেহাগ বলে আলতো করে, খুঁজে নিতে হবে আমাদের। পারবে না ?
——- যদি খুঁজে কিছুই না পাই ? গলায় বরফগলা হতাশা।
——- ফিরে আসবো !
——- কোথায় ?
হঠাৎ দূরে কোথাও একটা পাখি ডেকে ওঠে। ডাকটা শোনে। এই ডাকের মধ্যে ফিরে পায় তার স্বপ্নের ছবি। যা শোনার জন্য হর্ষা তাকিয়ে আছে চোখের আকাশ মেলে।
——– হর্ষা ।
——- হুঁ…
——- তোমাকে দ্বীপটা সম্বন্ধে সব বলা হয় নি।
——- আরও কথা আছে নাকি ? গলায় অভিমানের গাঢ কুয়াশা।
আছে হর্ষা আছে। সেই দ্বীপে থাকবে আমাদের বাড়ি। নীল রঙের, আকাঙ্ক্ষার রঙ, আমরা ভেসে চলবো, ভাসতে ভাসতে আমরা রক্তের ঋণ শোধ করবো। তুমি আমি ছাড়া আমরা হয়তো দুই থেকে তিন বা চার হবো। তাদের জন্য আমার মা শীতের কথা ভেবে পশমের পোশাক বানাবে। আর আমার বাবা ! তাদের কথা ভেবে গাছ ফুল আর পাখিদের নিয়ে গানের সুর তুলবে।
——- না না, হবে না।
——- কি হবে না ?
——– জায়গা হবে না। আরও জায়গা চাই । অনেক বড় জায়গা।
——- তুমি খুব জোরে ছুটতে চাও হর্ষা , আমি চাই না গো।
ওরা পাশাপাশি কাছাকাছি হাঁটছে। বেহাগ আর হর্ষা। ওদের শরীর বেয়ে নামছে জ্যোৎস্না। কেমন যেন শীত শীত করে। শরীরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্নার টুকরো ওরা মুছে ফেলে। বেহাগ ভাবে, বেহালার সুমধুর সুর কেটে গেল… আর হর্ষা ! যার নামে লুকানো আছে পরম আনন্দ সুখ।
এই দীর্ঘপথে অস্বাভাবিক চুপ করে থাকার পর অধৈর্য হর্ষা প্রথম কথা বলে।
——– কি ঠিক করলে ?
——– কিসের ঠিক ?
——– দায়িত্ব নেবার আগে সব পুরুষই ওরকম ন্যাকামার্কা কথা বলে।
——– আমি তো দায়িত্ব এডিয়ে যাচ্ছি না ? যেটা ঠিক করেছি সেটাই হবে।
——– শেষমেশ বিয়ের পর ধ্যাড়ধ্যাড়ে বৈকন্ঠপুর। জলা জঞ্জাল। লম্বা টালির বাড়ি। নিকোনো উঠোন।তুলসী মঞ্চ। হেঁপো শ্বশুর। হাজারো ব্রত মানা বুড়ি শাশুড়ি ডিসগ্যাসটিং জাস্ট ডিসগ্যাসটিং। হাল্কা রঙিন চুল ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলতে থাকে হর্ষা।
——- কি হবে তবে ?
——- আমার বাবা ফ্ল্যাট বুক করে রেখেছে, দক্ষিণ খোলা বিশাল সাজানো গোছানো ফ্ল্যাটে তুমি রাজা আর আমি তোমার… টাকাটা বাবা-ই দিয়ে দেবে।
——– আর কিছু বলবে বলো ? নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির মতো সরু চোখে তাকায় হর্ষা।
——- না । একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ফেলে বেহাগ।
——- ওকে ! সো উই আর গোয়িং টু বি সেটেল্ড ।
কথাটা বেহাগের কানে এলার্ম-ঘড়ির মতো ঝংকার তোলে। বেহাগ হর্ষার কথায় উত্তর দিতে গিয়েও চুপ থাকে। পিছন থেকে ছুটে আসা দুচোখ জ্বালিয়ে i20 পাশে এসে দাঁড়ায়। পারফিউমের উগ্র গন্ধ রেখে হর্ষা i20 এর কোলে গিয়ে বসে। ধোঁয়া উড়িয়ে জ্যোৎস্নার পেট চিড়ে বেরিয়ে যায় i20.
চেয়ে থাকে বেহাগ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *