পান্না হলো সবুজ ©কাজরী বসু

পান্না হলো সবুজ

©কাজরী বসু

পর্ব(৪)

কথাটা শুনে একটু চমকেই গেলাম। এরকম হতে পারে সেটা আসলে মাথাতেই আসেনি।
বিষয়টা এতটাই ব্যক্তিগত যে এরপরে কী জিজ্ঞেস করব তা বুঝতে পারছিলাম না।

তিস্তা নিজেই আবার বলল,
…আসলে আমার মুখের দিকে চেয়েই তো মানি রাজি হয়েছিল বিয়েতে,কিন্তু মানি যে অন্য একজনকে আগে থেকেই ভালোবাসত। বাপিকে হাজবেন্ড হিসেবে কখনো মেনে না নেওয়ার শর্তেই মানি বিয়েতে রাজি হয়। বাপিও আমার জন্য সেই শর্ত মেনে নেয়।
….হুম বুঝলাম।
….মানি এখনো মনে মনে তাকেই ভালোবাসে যাকে প্রথম থেকেই ভালোবাসত। আর শুনলে অবাক হবেন, তিনি কিন্তু আজও বিয়ে করেননি।
….বলেন কী!
….হ্যাঁ। বাপি সেটা জানত বলে এই ভয়টা পেত যে বাপির অবর্তমানে মানি যদি তাকে বিয়ে করে নেয়! সেক্ষেত্রে আমার আর্থিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। তাই এত রকমের সাবধানতা। আমায় জেম দিয়ে যাওয়া। সব ওই ভয় থেকে। কিন্তু শেষরক্ষা আর হলো কই!

….কেন,আপনার মানি কি সত্যি সত্যিই…
…..দেখুন,আমি জানিনা সেটা কিন্তু মানিই বা সারাজীবন আমার জন্য কেন নিজেকে বঞ্চিত করে যাবে বলুন তো! মানির এই কষ্ট তো আমারই জন্য,নয়?.. মানি বিয়ে করুক আমিও তা চাই। সেই সঙ্গে বাপির দিয়ে যাওয়া জিনিসগুলোও চাই। আমি নিজেরও ক্ষতি চাই না।

….আচ্ছা বলছিলাম যে,এত কথা আপনি কীভাবে জানলেন?
….মানি আর আমার ফ্রেন্ডশিপটা মোটেই হেলাফেলা করার মতো নয়। শি ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। ইনডিড।

বাড়ি ফিরে স্নান করলাম ভালো করে। সব কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছিল। স্নানের পর ধোঁয়া ওঠা চা আর অনন্ত সোমের নোটপ্যাড নিয়ে বসলাম।

খাতাটা জুড়ে প্রচুর কাটাকুটি , আর অনেক কিছু লেখাও। আর হাতের লেখাটিও পরশু পাওয়া চিরকুটের সঙ্গে মিলছে।

এখানেও সূত্রের মতো কিছু ছেঁড়াছেঁড়া লেখা।

যেমন
তুমি এক গুজুবুজু বুজুবুজু এলে।
একদম তাকাবে না। দেব চোখ গেলে!
কি করে তা জানবে না। ওরা যাবে খুঁজে।
তারপর? ঘুম দিও চক্ষুটি বুজে।

আবার এক জায়গায়..

তুরু রুরু তুরু রুরু
আমি লঘু তুই গুরু!
আজ থেকে হোক শুরু
প্লাক কর। কই ভুরু!

যদি সত্যিই এগুলো ক্লু হয়,তাহলে এই এত ধাঁধা কেন লিখে গেলেন অনন্ত সোম,তাই ভাবছি। মেয়েকে একবার ডেকে কোথায় কি রেখেছেন বলে দিলেই ল্যাটা চুকে যেত। এত রহস্য সৃষ্টি করা কি খুব জরুরি ছিল?

নাকি এসব কিছুই কোনো রহস্য নয়! এ এমনিই ছড়া লেখার প্রয়াস মাত্র।
বোঝা যাচ্ছে না। দেখি,কাল আবার ভাবব। আজ একটা টানা ঘুম দরকার।

….হ্যালো, তিস্তা তোমাদের, আই মিন আপনাদের যে জুয়েলারি শপ আছে সেখানকার কোনো কর্মচারীকে কি চেনো,আই মিন চেনেন?
…এই আপনি আজ্ঞেটা সত্যিই আর টলারেট করাই যাচ্ছেনা, আমাকে কেউ আপনি বলে জিন্দেগিতে দেখিনি। আমি কি মধ্যবয়সী মহিলা?
….আর আমিও কি সাত বুড়োর এক বুড়ো নাকি,আশ্চর্য!
….ওকে ডান। কি যেন বলছিলে! হ্যাঁ আছেন একজন। নরেশ জেঠু। বাপির সময় ছিল। এখন তো আর দোকানে যান না। বাপি চলে যাবার পর রিটায়ার করে গেছেন।
….তাহলে তো আরও ভালো। তোমার মানির আড়ালে কথা বলা যাবে। নাম্বার আছে?
…..ছিল তো,ওয়েট,ওয়ান মিনিট…
হুম,সেন্ড করে দিচ্ছি। দেখে নাও।

নরেশ বাগচি থাকেন জামির লেনের এক পুরোনো বাড়িতে।
বয়েস তো হয়েইছে,শরীরও তেমন ভালো নয়। খুব অমায়িক সজ্জন,খাতির করে আমায় বসালেন।তক্তাপোশ ছাড়া আর কোনো বসার জায়গাও অবশ্য নেই ঘরে।
…চা খাবে ?
….না না,এই ভাত খেয়ে বেরোলাম।
……তাহলে বলো কী জানতে চাও।
…আপনি তো দুর্গা জুয়েলারি স্টোর্স এ বহুদিন কাজ করেছেন। অনন্ত বাবু যে বেশ কিছু দামী পাথর নিয়ে যেতেন বাড়িতে মেয়ের জন্য, আপনি কি তা জানতেন?
….হ্যাঁ জানতুম। ওর নিজের দোকান,নিজের জিনিস,নিত,কার কি বলার আছে।
….সেটাই তো কথা। তাহলে পাথর নিয়ে এত লুকোছাপা কেন?
….অনন্ত কাউকে মনে হয় ঠিক বিশ্বাস করতে পারত না। ও ভাবত পাথরের কথা জানতে পারলে তা বেহাত হয়ে যেতে পারে। ও লুকিয়ে রেখে যেতে চাইত সব।
….কিন্তু আপনাকে তো বিশ্বাস করতেন উনি। বিশ্বাস করে এত সব বলতেন।
…হ্যাঁ,কারণ আমাকে ও চিনত। জানত আমার দ্বারা ওর পরিবারের কারো ক্ষতি হবার নয়।
….কিন্তু নিজের স্ত্রীকেও…
…প্রিয়া ওর স্ত্রী আবার ছিল কবে? প্রিয়ার সঙ্গে ওর কাজের কথা ছাড়া আর কোনো কথাই হতো না। একটা মানুষ কেমন তা জানতে গেলে তো তার সঙ্গে টাইম স্পেন্ড করতে হয়! তবে তো জানা যায় সে ভালো না মন্দ,রাগী না শান্ত,ঠগ না বিশ্বাসী! স্ত্রীকে অনন্ত চিনতই তো না,তাকে বিশ্বাস করবে কেমন করে?
….অনন্ত বাবুর ব্যক্তিগত কথা আপনি তার মানে অনেকটাই জানতেন। তাহলে এটাও কি জানতেন না যে পাথরগুলো উনি কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন?
…..দেখো ভাই, সেটা জানলে আমি কি আর তিস্তাকে সে হদিশ অ্যাদ্দিনে দিতুম না? সে কি আমার শত্তুর?
….অনন্ত বাবুর কথায় কখনো কোনো আঁচ পাননি?
….না,এত কথা তো হতই না। কঠিন রোগে বেচারি একেবারে কাবু ছিল। কীভাবে সুস্থ হবে সেই চিন্তা করত সর্বক্ষণ।
….পাথরগুলো উনি কি স্ত্রীর ভয়ে লুকিয়ে রাখতেন তাহলে?
….ওই যে বললাম,স্ত্রী বিশ্বাসযোগ্য কি না তা বোঝার সুযোগ ওর হয়নি। আসলে কি বলো তো, কোনো বাপই তার সন্তানের সৎ মাকে বিশ্বাস করে না। সেই মা তার মাসিই হোক বা অন্য কেউ। অনন্তও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
…কিন্তু উনি এই লুকোনোর জায়গাটার কথা মেয়েকে কেন বলে গেলেন না?

….. অনন্ত অনেকদিন অবধি নিজেই জানত না কোথায় ওগুলোকে রাখবে। আমায় বলত,নরেশ দা,এই সব দামী দামী জেমগুলো কোথায় যে রেখে যাই। মেয়েটা যাতে খুঁজে পায় তেমন জায়গায় তো রাখতে হবে। তারপর ওকে ডেকে চুপিচুপি বলে দেব। এই সব কথা ও আমায় বলেছে বেশি দিন আগে তো নয়! মারা যাবার কয়েকদিন আগে বলল,নরেশ দা,একটা জায়গার কথা অনেক ভেবে বের করেছি। আমি আগে সেফলি ওগুলোর গতি করি। ক্লুও রাখছি, কাজটা শেষ হলেই মেয়েকে আসতে বলব। ওরও তো বললেই আসা হয় না,পড়ার খুব চাপ। নিজের পায়ে তো দাঁড়াতে হবে ওকে। আমি তো এই আছি এই নেই। তাই না! কিন্তু এত কিছু মেয়েকে জানাতে আর পারল কই, তার কয়েকদিনের মধ্যেই তো…

জামির লেন হয়ে আসতে গিয়ে আজ একটু দেরিতে ঢুকলাম।
….তিস্তা,তোমার বাবা কোন ঘরে থাকতেন?আজ সেই ঘরটা দিয়ে স্টার্ট করি।
….বাপি ওদিকের কিচেনের পাশের ঘরে একাই থাকত। ঘরটায় আমি ঢুকিনা। খুব মন খারাপ হয়।
…আচ্ছা আমি তবে একাই যাই।
….তুমি যাও,আমি আসছি।

অনন্ত সোমের ঘরটা বেশ গুছিয়ে রাখা। আসবাব অবশ্য খুব কম। একটা সিঙ্গল বেড, তার একদিকে আয়না দেওয়া স্টিলের আলমারি,অন্যদিকে একটা কাঠের ওয়ার্ডরোব,তার পাশে ছোট একটা এল ই ডি টিভি দেয়ালে লাগানো। জুয়েলারির দোকানের মালিক,ঘরে কোনো গুপ্ত সিন্দুক টিন্দুক নেই? দেয়ালগুলো টোকা দিয়ে দেখব? সিরিয়ালে যেমন দেখায়,দেয়ালে একটা রঙের তফাত,তার মধ্যে লুকোনো মণিকোঠা। ভেবে নিজেরই হাসি পেল অবশ্য। এ ঘরে সেরকম কিছু আছে বলে বিশ্বাস হচ্ছে না। থাকবেই বা কোথায়! দুদিকে বড়ো বড়ো দুটো জানলায় অর্ধেক দেয়াল কভার করে গেছে। কিন্তু তাহলে পাথরগুলো ভদ্রলোক রাখলেন কোথায়?

জানলাগুলো খোলা,ঘরে বেশ আলো। বাঁদিকের জানলার ঠিক পাশে ওপাশের বাড়ির জানালা। অন্য দিকের জানলা দিয়ে নিচে তাকালাম। সেদিনকার সেই টবগুলো না! ছোট্ট বাটির মতো লাগছে উপর থেকে। কাগজের টুকরোগুলো নিশ্চিত ভাবেই এই জানলা দিয়েই ফেলা হয়েছে। হয়তো ভদ্রলোক মারা যাবার পর ঘর পরিষ্কার করতে যাবার সময় উড়ে নিচে পড়ে গেছে। কিংবা উনিই লিখে ফেলে দিয়েছেন।

….নিচে কি দেখছ?
তিস্তা এসে পড়েছে কখন যেন।
….না,এই একটু দেখছিলাম..
….তোমার তল্লাশি কদ্দূর?

…চলছে ম্যাডাম,কিন্তু ক্রমশ হতাশ হচ্ছি..

বাড়ি ফিরে ছড়াগুলো নিয়ে বসলাম। লেখাগুলোর মধ্যে কোথাও একটা কিছু ঘুরছে। কী সেটা তা না বুঝতে পারলেও একটা কিছু যেন মাথার মধ্যে…

কোথায় গেল নখ
ভেজাস না আর চোখ

সব কি থাকে কন্যে
শুধুই দেখার জন্যে!
মন না দিলে আমার কথায়
খুঁজবি হয়ে হন্যে

তুমিও যেমন মিষ্টি
তেমনটা এই পিস টি
কিন্তু তুমি এও কি জানো
ওর যে সজাগ দৃষ্টি!

তুমি এক গুজুবুজু বুজুবুজু এলে
একদম তাকাবে না। দেব চোখ গেলে।
কী করে তা জানবে না। ওরা যাবে খুঁজে
তারপর ঘুম দিও চক্ষুটি বুজে।

তুরু রুরু তুরু রুরু
আমি লঘু তুই গুরু
আজ থেকে হোক শুরু
প্লাক কর। কই ভুরু?

এই এতগুলো সূত্রের সাহায্যে ঠিক কী বলতে চেয়েছিলেন ভদ্রলোক?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *