কথা দিয়েছিলাম —- বিক্রম ঘোষ — পর্ব – ৪

কথা দিয়েছিলাম
বিক্রম ঘোষ

পর্ব – ৪

শান্তিনিকেতনে গৃহীত সিদ্ধান্ত, আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু। বিস্তারিত জানিয়ে ক্লাসের বন্ধুদের মতামত চাওয়া হলো। প্রত্যেকে সমর্থন করেছিল ওদের পরিকল্পনা। একটা কমিটিও গঠন করা হলো। এখন বাকি শুধু লেখা পাওয়া আর ছাপানো।

কয়েকদিনের মধ্যে লেখা জমা পড়তে শুরু করেছে, বিমলের কাছে। সম্পাদনার কাজটা বিমলই করবে, যদিও খাতায় কলমে সম্পাদক হিসাবে নাম থাকবে সুজয়ের। কী বিচিত্র এই জগৎ, যে সুজয় কোপাইয়ের পাড়ে প্রতীকের প্রস্তাবে বিদ্রুপ করেছিল, সেই সুজয়ের নাম আজ সম্পাদকের জায়গায়। সেটা অবশ্য বিমলের ইচ্ছাতেই। ও তেমন বলিয়ে কইয়ে নয় বলেই এমন ব্যবস্থা।

অনেক আলোচনা, অনেক কাটাছেঁড়া, অবশেষে লেখার পরিমান যা দাঁড়াল সেটা মোটামুটি পাতলা একটা পুজোবার্ষিকীর সমান। এত লেখা নিয়ে বই ছাপাবার পয়সা কোথায়? সবাই তো টিউশনি, হাতখরচের পয়সা বাঁচিয়ে সাহায্য করবে। খুব বেশি হলে বাবা, মা, দাদা, দিদির কাছে হাত পাতবে। অল্প পুঁজিতে এত বড়ো কাজ সম্ভব নয়। তাহলে উপায়! ঠিক হলো, সবাইকে নিয়ে আবার বসা হবে, একটা সুরাহার খোঁজে।

ক্লাসের সেই সভায় অনেক হইচই, ঝগড়াঝাঁটি, মনোমালিন্যের পর ঠিক হলো আপাতত বই ছাপানো হবে না, প্রকাশ করা হবে দেওয়াল পত্রিকা।

বিমল এখন অনেকটা ঝাড়া হাত-পা। দায়িত্বের মধ্যে পড়ে এমন কাজ তার এই মুহূর্তে বিশেষ নেই। পত্রিকার কাজ চললেও আখেরের কথা ভেবে কেউই ক্লাস ফাঁকি দেয়নি। পড়াশুনার সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকায় লেখার কাজও চলছে, ক্লাসের ফাঁকে অথবা ছুটির পর।

এরই মাঝে একদিন ক্লাস শেষ করে একাই বাড়ি যাওয়ার জন্য সবে ইউনিভার্সিটির গেট পেরতে যাবে তখনই দূর থেকে কণিকার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, ‘এই বিমল, কোথায় যাচ্ছিস?’

বিমল খানিকটা অবাক হয়ে বলল, ‘কেন? বাড়িতে!’

জবাব এল, ‘দাঁড়া, আমি আসছি।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে বলল, ‘আমার সঙ্গে একটু যাবি?

বিমল একটু দ্বিধান্বিত স্বরে বলল, ‘কোথায়?’ কণিকা শুধু ‘আয় না’ বলে হাঁটতে লাগলো।

বাড়ি ফেরার তাড়া না থাকায়, আর যাওয়াটা উচিত মনে করে ওর সঙ্গে হাঁটতে লাগল বিমল। খানিকটা হাঁটা, সামান্য কিছু কথা আর তারপরেই কৈফিয়তের স্বরে বিমলের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল কণিকা, ‘পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় তোর লেখাটা তুলে নিলি কেন?’

বিমল নিজের যুক্তিতে স্থির থেকে বলল, ‘দেওয়াল পত্রিকার মতো ছোট জায়গায় বেশি লেখা রাখা সম্ভব নয়, সেটা বুঝিস না? যে প্রতীক, এই পত্রিকার কথা প্রথম ভেবেছিল সে পর্যন্ত লেখা তুলে নিল আর তুই আমাকে বলছিস! কমিটির সদস্যদের মধ্যে সুজয়, স্বপন আর বন্দনার লেখা রয়েছে। একইসঙ্গে আমার নিজের লেখাকে প্রাধান্য দিলে ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু হতো, তাই তুলে নিয়েছি। তা ছাড়া, আমার লেখাটা ছিল প্রবন্ধ ধরণের, গল্প বা কবিতা নয়। অল্প কথায় এই ধরণের লেখা ভাল হয়না। এইসব কাজের চাপে, আমি নিজের লেখাতে বিশেষ মনোনিবেশ করতে পারিনি আর লেখাটা আমার নিজেরও ঠিক মনঃপুত হয়নি। দেওয়াল পত্রিকায় গল্প, কবিতার প্রাধান্য পাওয়া উচিত।’

কণিকা পাল্টা জবাবটা দিল বেশ শ্লেষাত্মক ঢঙে, ‘বাঃ-বাঃ, পত্রিকার ব্যাপারে অনেক কিছুই ভেবেছিস দেখছি। তাহলে গল্প বা কবিতা লিখলি না কেন? নাকি নিজের ব্যাপারে গভীরে ভাবতে চাস না?

তারপরেও কণিকা কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল কিন্তু পারছিল না। কোনো কিছু যেন ওর কণ্ঠ রোধ করে রেখেছিল।

বিমল ঠাহর করতে পারছিল না এমন খামখেয়ালি বন্ধুকে কিভাবে সামলাবে আর ব্যাপারটাই বা কোন দিকে যাচ্ছে। ভাবছিল উত্তর দেবে, বানিয়ে বানিয়ে লেখা ওর আসে না। কিন্তু চুপ করে থাকাই ঠিক মনে হলো।

তখনই হঠাৎ বিমলের পরা খদ্দরের পাঞ্জাবিটা খামচে ধরে মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে কণিকা বলল, ‘কেন, তোমার শরীরে কি কল্পনা নেই?’

শিরদাঁড়া দিয়ে হিমশীতল কী যেন একটা বয়ে গেল বিমলের। একেবারেই প্রস্তুত ছিল না বিমল, এ ধরণের ভাষা বা প্রশ্ন শোনার। ওর দিকে না তাকিয়ে শুধু বলল, ‘কল্পনা তো সবার মধ্যেই থাকে, আমার মধ্যেও আছে। কল্পনা কিন্তু শুধু কল্পনাই। আমি চূড়ান্ত বাস্তববাদী। তুই হয়তো কল্পনাকে বাস্তব রূপ দিতে পারিস, এমন হয়তো অনেকেই পারে, আমি পারি না।’ এই ধরণের কথোপকথন বিমলের ভাল লাগছিল না। তাই, ইচ্ছে করেই কথার শেষ দিকে একটু ঝাঁঝ মিশিয়েছিল।

কণিকা বলে, ‘তুমি ভাষার সুন্দর ব্যবহার জানো বলে তোমার খুব অহংকার, তাই না?’

কণিকার মানসিক অবস্থা চিন্তা করে বিমলের খুব অস্বস্তি লাগছিল। ওর সঙ্গে না এলেই বোধহয় ভালো হতো। এখন আর সেসব ভেবে লাভ কী! তবুও যতটা সম্ভব নির্লিপ্ত থাকা যায় সেভাবেই বলল, ‘কী সব যা তা বকছিস, সবই তো বইয়ের ভাষা। অভিনবত্ব কোথায় দেখলি? যা লিখি সবই জানা কথা, একটু যা এদিক ওদিক।’

কণিকা কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থাকে। এবার আর কৈফিয়ত নয়, অনেকটা আদেশের সুরে বলে, ‘পত্রিকার পরের সংখ্যায় তোমার লেখা থাকতে হবে। তুমি লিখবে, গল্প বা কবিতা। যা হোক।’

কণিকার ওপর কী যেন একটা ভর করেছিল সেদিন। বিমল বুঝতে পারছিল না। আবেগ মাখানো কণ্ঠস্বরে ক্রমাগত এই ভাষা ওকে কেমন যেন বিহ্বল করে দিচ্ছিল।

তারপরে, হঠাৎই কণিকা ভর রাস্তায় বিমলের পথ আগলে সামনাসামনি এসে দাঁড়ায়। চোখে চোখ রেখে বলে, ‘আমাকে এখানে দাঁড়িয়ে কথা দাও, আগামী সংখ্যায় তোমার একটা গল্প বা কবিতা থাকবে। তোমার নাম আমি পত্রিকায় দেখতে চাই।’

বিমলের মাথা কাজ করছিল না। কেমন একটা অবশ, আচ্ছন্ন ভাব ক্রমশঃ গ্রাস করছিল ওকে। নিজের কানেই বিমল নিজের গলার স্বর শুনেছিল দূর থেকে ভেসে আসা শব্দের মতো, ‘বেশ, লিখব।’ যদিও বিমলের মনে হয়েছিল সে নিজের ক্ষমতাকে লঙ্ঘন করছে।

বিমল কিছু যেন একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ততক্ষণে কণিকা বেশ খানিকটা দূরে চলে গেছে।

(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *