ফিরে দেখা ছোট বেলা, সম্পাদকীয়

ফিরে দেখা , ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজা।

শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি।
ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।।

শরৎ তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে
বনের-পথে-লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।।

মানিক-গাঁথা ওই-যে তোমার কঙ্কণে
ঝিলিক লাগায় তোমার শ্যামল অঙ্গনে।

কুঞ্জছায়া গুঞ্জরণের সঙ্গীতে
ওড়না ওড়ায় একি নাচের ভঙ্গীতে,
শিউলিবনের বুক যে ওঠে আন্দোলি।।

যে ঠাকুরবাড়ি ছিল ব্রাহ্ম অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক, সেখানে দুর্গাপুজোর মতো সাকার ঈশ্বর সাধনা হত কীভাবে? কে শুরু করেছিলেন এই পরিবারে পুজো আর সে পুজো বন্ধই বা হল কীভাবে? এসব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজোর ইতিহাস জানতে হলে যেতে হবে ঠাকুরবাড়ির গোড়ার কথায়।

যশোর জেলা থেকে কলকাতায় এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ থেকে সাত পুরুষ আগের পঞ্চানন কুশারী। কলকাতা শহরে আগন্তুক ব্রাহ্মণ পঞ্চানন সুতানুটি অঞ্চলে, গঙ্গার ঘাটে ব্যবসায়ীদদের পুজোআর্চা করতেন।লোকেরা তাকে ডাকত ঠাকুরমশাই, সেই থেকে তার নাম হয় পঞ্চানন ঠাকুর এবং পরবর্তীকালে তার উত্তরসূরীদের পদবীও হয় ‘ঠাকুর’। পঞ্চানন ঠাকুরের দুই নাতি নীলমণিঠাকুর এবং দর্পনারায়ণঠাকুরের মধ্যে বিষয়সম্পত্তি নিয়ে সবসময় বিবাদ লেগে থাকত।এই বিবাদের জেরে নীলমণিঠাকুর একদিন কুশারী বংশের গৃহদেবতা লক্ষী এবং শালগ্রামশিলা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যান।পরবর্তীকালে তিনি কলকাতার মেছুয়াবাজার অর্থাৎ আজকের জোড়াসাঁকো অঞ্চলে এক সুবিশাল গৃহ নির্মাণ করেন। সুতরাং নীলমণিঠাকুরই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি পত্তন করেছিলেন এবং সেই সাথে তিনি ঠাকুরপরিবারে দুর্গাপুজোও শুরু করেছিলেন। তবে ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো নীলমণি ঠাকুরের নাতি প্রিন্স দ্বারকানাথের হাত ধরেই রাজকীয় আকার ধারণ করেছিল।

এবার আসি পুজোর কথায়! মাথায় গঙ্গানদী নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঠাকুরবাড়িতে সমস্ত সাত্যিকতা মেনে প্রতিমা গড়ার মাটি আসত গঙ্গার পাড় থেকে। উন্মুক্ত ঠাকুরদালানে চলত ঠাকুর তৈরির কাজ যখন থেকে খড়ের কাঠামোর গায়ে মাটি পড়ত, সেই প্রতিমা গড়বার সময় থেকেই ঠাকুরবাড়ির ছোট ছোট ছেলেরা ঠাকুর দালানে গিয়ে ভিড় জমাত, ‘আর সবাই মিলে সীমাহীন আনন্দে মেতে উঠতেন।কবির মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা থেকে জানতে পারি- ‘প্রথমে খড়ের কাঠামো , তার উপরে মাটি, খড়ির প্রলেপ, তার উপরে রং , ক্রমে চিত্র বিচিত্র খুঁটিনাটি আর সমস্ত কার্য , সর্বশেষে অর্ধচন্দ্রাকৃতি চালের উপর দেবদেবীর মূর্তি আঁকা ,তাতে আমাদের চোখের সামনে বৈদিক, পৌরাণিক, দেবসভা উদঘাটিত হত| —রাংতা দিয়ে যখন ঠাকুরদের দেহমণ্ডল,বসনভূষণ ,সাজ সজ্জা প্রস্তুত হত আমাদের বড়ই কৌতূহল হত। অর্ধচন্দ্রাকৃতির একচালার মূর্তিই ছিল ঠাকুরবাড়ির পুজোর বৈশিষ্ট্য। তবে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত প্রতিমার মুখের আদলের ওপর। প্রিন্স দ্বারকানাথের স্ত্রী দিগম্বরীদেবী ছিলেন অসামান্যা সুন্দরী এক নারী, কথিত আছে ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজোর মায়ের মূর্তি একটা সময়ের পর এই দিগম্বরীদেবীর মুখের আদলে তৈরি করা হত। মাকে পরানো হত প্রচুর সোনার গয়না, মাথায় সোনার মুকুট থেকে কোমরে চন্দ্রহার সবই মায়ের গায়ে শোভা পেত। মূর্তিকে দু’বেলা বানারসী শাড়ি বদল করে পরানো হত, আবার কখনো পরানো হত দামী তসর কিংবা গরদের শাড়ি। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজোয় মায়ের ভোগ ছিল দেখার মতো। দু’বেলা অন্ন থেকে মিষ্টান্ন সব মিলিয়ে একান্ন রকমের পদ মা’র ভোগ হিসাবে নিবেদন করা হত, সাথে থাকত ফল, ডাবের জল ইত্যাদি। পরে সেগুলো ঠাকুরবাড়ির পুজোর দর্শনার্থীদের মধ্যে প্রসাদ হিসাবে বিতড়ণ করা হত। সেই সময় একদিকে বাংলায় ব্রিটিশ শাসন অন্যদিকে বাংলার মনীষীদের প্রভাবে নবজাগরণের জোয়ার চলছিল, তাই তখনকার সমাজের বিশিষ্ট মানুষরা ঠাকুরবাড়ির দুর্গোৎসবে আমন্ত্রণ পেতেন। আমন্ত্রণপত্র লেখা হত দ্বারকানাথের পিতা রামমণি ঠাকুরের নামে। একবার পিতামহের সেই আমন্ত্রণপত্র নিয়ে বারো বছর বয়সের বালক দেবেন্দ্রনাথঠাকুর গিয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়কে নিমন্ত্রণ করতে, রামমোহনকে গিয়ে তিনি বলেছিলেন : ” সামনে পুজো তাই তিনদিনই প্রতিমাদর্শনে আপনার নিমন্ত্রণ, পত্রে দাদুর এই অনুরোধ।” প্রতিমাপুজোয় বিরোধী রামমোহন রায় এই আমন্ত্রণে খুব বিস্মিত হয়েছিলেন। যদিও বন্ধু দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথকে তিনি খুব স্নেহ করতেন তাই নিমন্ত্রণপত্রটি প্রত্যাখ্যান করেননি আবার সরাসরি সেটা গ্রহনও করেননি, তিনি তাঁর ছেলে রাধাপ্রসাদের কাছে দেবেন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। রাধাপ্রসাদ পিতার হয়ে সেটা গ্রহন করে দেবেন্দ্রনাথকে মিষ্টিমুখ করিয়ে দিয়েছিলেন।

প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রতি বছর পুজোয় বাড়ির ছেলেমেয়ে এবং বউদের দামী দামী পোশাক উপহার দিতেন। পুজোর তিনমাস আগে থেকে দর্জিরা ঠাকুরবাড়িতে চলে আসতেন এবং সেখানে বসে তারা বানাতেন সকলের পুজোর পোশাক- ছেলেদের জন্য জড়ির টুপি, চাপকান, ইজার এবং মেয়েবউদের জন্য পছন্দমত জামাকাপড় সাথে নানা কাজ করা রেশমি রুমাল। পুজোর জন্য ঠাকুরবাড়ির প্রত্যেক মেয়েবউ দ্বারকানাথের কাছ থেকে উপহার পেতেন এক শিশি দামী সুগন্ধী, খোপায় দেওয়ার সোনা বা রুপোর ফুল, কাঁচের চুড়ি আর নতুন বই।আসলে দ্বারকানাথ পার্বণী দেওয়ার ব্যাপারে খুব দরাজ ছিলেন। বাড়ির দুর্গাপুজোয় ছোট থেকে বড়, মেয়েবউ এমনকি বাড়ির ভৃত্য-কর্মচারীরাও পেতেন। দুর্গাপুজোর মতো প্রতিমা বিসর্জনের পালাও ছিল সমান রাজকীয়। দশমীর দিন নানা রকমের বাদ্যি আর গ্যাসবাতি নিয়ে এগিয়ে যেত বিসর্জনের শোভাযাত্রা। পাশেই গঙ্গা আর সেই গঙ্গা পর্য্যন্ত মাতৃপ্রতিমার সাথে বাড়ির মেয়েবউরা দরজা বন্ধ করা পাল্কিতে এগিয়ে গিয়ে বাড়ির উমাকে বিদায় দিতেন, সাথে যেত পিতলে বাঁধানো লাঠি হাতে প্রহরী। তবে প্রতিমা বিসর্জনেরর ক্ষেত্রে যে কথাটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি তা হল বিসর্জনের সময় মায়ের শরীরে পরানো সোনার গয়না খুলে নেওয়া হত না, সেগুলো সমেত গঙ্গাবক্ষে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হত। পরে নৌকোর মাঝি বা অন্যান্য কর্মচারীরা জল থেকে সে গয়না তুলে নিতেন কিন্তু ওইসব গয়না আর কখনোই ঘুরে ফিরে ঠাকুরবাড়িতে আসত না। আর এখানেই ছিল ঠাকুরবাড়ির বনেদিয়ানার জিত ! একালের মতো দুর্গাপুজোর পর ঠাকুরবাড়িতেও স্বাভাবিক নিয়ম মেনে হত বিজয়া সম্মেলনী। সেই উপলক্ষে হত মস্ত জলসা- খোলা ঠাকুরদালানে নাচ,গান, নাটক এবং অন্যান্য আমোদপ্রমোদের ব্যবস্থাও করা হত। সেকালের নামকরা ওস্তাদেরা তানপুরা নিয়ে এসে গানে মাত করে দিতেন, রাজকীয় ঝাড়বাতির নীচে চলত বিজয়ার রাজসিক খাওয়াদাওয়া- মিষ্টিমুখ,গোলাপজল, আতর, পান আর কোলাকুলি।

একদা বারো বছরের যে বালক দেবেন্দ্রনাথ পিতার বন্ধু রাজা রামমোহন রায়কে পারিবারিক পুজোয় নিমন্ত্রন জানাতে গিয়েছিলেন, কুড়ি বছর বয়সে পৌঁছে সেই দেবেন্দ্রনাথই উপনিষদের প্রথম শ্লোকের অর্থের মধ্যে ব্রহ্মজ্ঞান খুঁজে পেয়েছিলেন। রামমোহনের ‘একেশ্বরবাদ’ মতবাদ সম্পর্কে তখন তিনি অবগত। একেশ্বরবাদ চর্চার লক্ষে তিনি গড়ে তুললেন ‘তত্ত্বরঞ্জিনী সভা’। পরে এর নাম পাল্টে হয় ‘তত্ত্ববোধিনী’ সভা এবং সেই সভার সাথে ‘ব্রহ্মসভা’ যুক্ত হয়। এই সভার দায়িত্ব নিয়ে পঁচিশ বছরের তরুণ দেবেন্দ্রনাথ ব্রাক্ষধর্মকে দীক্ষার ধর্মে রূপায়িত করে ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা করলেন। দ্বারকানাথের জেষ্ঠ্যেপুত্রের হাত ধরেই ঠাকুরবাড়ি ধীরে ধীরে ‘ব্রাহ্ম’ পরিচয় প্রাপ্ত হল এবং দুর্গাপুজো সেই বাড়িতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল। যদিও এই পুজো বন্ধের ব্যাপারে সকলে সমান মতের অধিকারী ছিলেন না। দেবেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ ভ্রাতা নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন – “দুর্গোৎসব আমাদের সমাজের বন্ধন, সকলের সাথে মিলনের এক প্রশস্ত উপায়। ইহার উপর হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়, করিলে সকলের মনে আঘাত লাগিবে..”। এরপরও দু’তিন বছর ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপুজো হয়েছিল কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই পুজোয় আর অংশগ্রহন করতেন না, পুজোর সময় তিনি চলে যেতেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় নতুবা তাঁর প্রিয়স্থান হিমালয়ে ।

দুর্গা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবধারার প্রকাশ ঘটেছিল একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে| তিনি তখন শিলাইদহে| শচীন্দ্রনাথ অধিকারীর লেখা বই থেকে জানতে পারা যায় –শিলাইদহে কবি সে সময় জমিদারীর বিভিন্ন কাজ নিয়ে খুবই ব্যস্ত | এসবের মধ্যেই তিনি বিশদভাবে ভাবছেন শিলাইদহে খুব বড় ধাঁচের একটি মেলা বসাতে হবে| কবি ভাবনা-চিন্তা করে এই মেলার নাম দিয়েছিলেন ‘কাত্যায়নী’ মেলা| দেবী দুর্গাই কাত্যায়নী| শীত পড়তে আরম্ভ করেছে| এরই মধ্যে মা দুর্গার মতো প্রতিমা নির্মাণ হল কাত্য়াযনীর বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে। কাত্যায়নী মেলা’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর, বছর তিনেক বাদে আবার অন্য মেলার আয়োজন করা হল-মেলার নাম ‘রাজরাজেশ্বরী’ | তখন জমিদারি এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন বিপিন বিশ্বাস- তিনি অফুরন্ত মানসিক শক্তিতে ভরপুর|এই বিশাল কাজে তিনি হাত লাগালেন| নতুন করে তৈরি হল এক বিরাট পাকা মণ্ডপ| দশমহাবিদ্যার ‘ ষোড়শী’ মূর্তি নির্মিত হয়েছিল|এই মেলা ও উৎসব হল পনেরো দিন ব্যাপী| রবীন্দ্র-বন্ধু আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ও নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ প্রমুক এই মেলায় আন্তরিক ভাবে যোগ দিয়েছিলেন|

যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গতানুগতিক নিয়মে ঈশ্বরের অনুসন্ধান করেননি। অনন্তের চৈতন্যই ছিল তাঁর সব কাজকর্ম ও ধ্যান-ধারণাজুড়ে। তিনি নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ঘর এবং গৃহকর্মের মধ্যেই ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছিলেন। কবিগুরু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, উৎসবের দিন একলার ঘর হয়ে ওঠে সবার ঘর।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৩ সালে কলকাতার বোলপুর থেকে কাদম্বিনী দেবীকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে তিনি ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর মতবাদ লিখেছিলেন। তার মতে, ঈশ্বর সাকার ও নিরাকার দুই-ই। শুধু ঈশ্বর নয়, তাঁর মতে আমরা প্রত্যেকেই সাকার এবং নিরাকার দুই-ই। তিনি ঈশ্বরবাদ নিয়ে কোনো বাদ-বিবাদে যেতে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি আকারে, রূপে, কর্মে ঈশ্বরের উপাসনা করাতেই বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মূর্তি পূজা করতে চাইতেন না। তবে প্রতিমা নিয়ে তাঁর কোনো দ্বিমত ছিল না। তাঁর মতে, যদি কোনো বিশেষ মূর্তির মধ্যেই ঈশ্বরের আবির্ভাবকে বিশেষ সত্য বলে না মনে করা যায় তাহলেই তাতে আর কোনো সমস্যা থাকে না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বোন সৌদামিনী দেবীর একটি লেখা থেকে জানা যায়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পূজার বাড়িতে থাকতেন না। পূজার সময় ঠাকুরবাড়িতে যত আচার-অনুষ্ঠানই হোক না কেন সেখানে রবিঠাকুরের মা স্বামীকে ছাড়া কোনোভাবেই নিজেকে শামিল করতে পারতেন না। ষষ্ঠীর দিন শুধু ছেলে-মেয়েরাই নয়, আত্মীয়-স্বজন, কর্মচারী, ভৃত্য এবং ঝিদের নতুন জামাকাপড় বিলি করে দেওয়া হতো ঠাকুরবাড়ি থেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ অত্যন্ত উদার মনের মানুষ ছিলেন এবং তিনি প্রচুর খরচ করতেন। পূজার সময়ে মোয়া, ক্ষীর প্রভৃতি মিশিয়ে ফুটবলের মতো দেখতে একটি বৃহদাকার মিঠাই তৈরি করা হতো সবার জন্য।

বীন্দ্রনাথের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেকালের ঠাকুরবাড়ির দুর্গোৎসব প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, পূজার দিনগুলোতে তাঁরা সন্ধ্যার দিকে দালানে যেতেন। সেখানে ধূপ জ্বালানো হতো। বিভিন্ন রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন বাদ্যযন্ত্রীরা। সন্ধ্যার আরতি দেখার জন্য এবং ঠাকুরকে প্রণাম করার জন্যই তাঁরা দালানে যেতেন। বিজয়ার দিন প্রতিমার নিরঞ্জনের মিছিলে ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা যোগ দিতেন। মহর্ষি-কন্যা সৌদামিনী দেবীর কথায়, ঠাকুরবাড়িতে যখন দুর্গোৎসব হতো তখন ছেলেরা বিজয়ার দিনে নতুন জামাকাপড় পরে প্রতিমার সঙ্গে যেত। আর মেয়েরা তখন তেতালার ছাদে উঠে প্রতিমা বিসর্জন দেখত। সৌদামিনী দেবীর লেখায় এও জানা যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিজয়ার রাতে শান্তিজল সিঞ্চন ও ছোট-বড় সবার মধ্যে কোলাকুলি করাটা খুব পছন্দ করতেন।

ছাড়াও, সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন, বিজয়ার দিন তাঁদের বাড়িতে গৃহনায়ক বিষ্ণু আগমনী ও বিজয়ার গান করতে আসতেন। অবনীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, বিজয়া তাঁদের জন্য খুব আনন্দের দিন ছিল। সেদিনও কিছু পার্বণী পাওয়া যেত। ঠাকুরবাড়ির যত কর্মচারী ছিলেন সবার সঙ্গে তাঁরা কোলাকুলি করতেন। বুড়ো চাকররাও এসে ঠাকুরবাড়ির ছোট-বড় সবাইকে প্রণাম করত। পরবর্তীকালে ঠাকুরবাড়িতে অনুষ্ঠিত “বিজয়া সম্মিলনী” প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের লেখায় জানা যায়, সেদিন ঠাকুরবাড়িতে মস্ত জলসা বসত। খাওয়া-দাওয়া হতো খুব। ওস্তাদ তানপুরা নিয়ে গানে গানে মাত করে দিতেন ঝাড়বাতির আলোয় আলোকিত সেই ঠাকুরবাড়ি। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মা দুর্গাকে খাঁটি সোনার গয়না দিয়ে সাজানো হতো এবং সালঙ্কার সেই প্রতিমাকে বিসর্জন দেওয়া হতো। প্রতিমা ভাসানোর সময়ও সেই স্বর্ণালঙ্কার খুলে নেওয়া হতো না। নৌকার মাঝি অথবা অন্য কর্মচারীরা পানিতে ঝাঁপ দিয়ে ওইসব গয়না তুলে আনত। কিন্তু সেই গয়না ফের ঠাকুরবাড়িতে নেওয়া হতো না. নাটকে। ১৯০০ সালের দুর্গাপুজোর সপ্তমীতে বন্ধু প্রিয়নাথ সেন কে রবীন্দ্রনাথ একটা চিঠিতে লিখেছিলেন – ” প্রকৃতির অনন্ত মাধুরী এবং অসীমতার মধ্যে যখন আমরা বিভোর হইয়া আমাদের সমস্ত প্রাণখানি ঢালিয়া দিই,তখনই প্রকৃত পূজা….”

এই ‘প্রকৃতপূজা’ কে উপলব্ধি করতে তিনি মহালয়ায় শান্তিনিকেতনে শুরু করেছিলেন একদিনের মেলা ‘আনন্দবাজার’। শরতের আবাহনে সেখানে আশ্রমিক ছাত্রছাত্রীরা মেতে ওঠে মাটির ঠাকুরপুজোর আনন্দে নয়, প্রকৃতির সাথে একাত্ম হওয়ার মনের নির্বিরোধ আনন্দে- স্থলপদ্ম, শুভেচ্ছা, শিউলির মাদকতায় আর ‘গীতবিতান’ এর পাতা থেকে উঠে আসা শরতঋতুর গানে – ” শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি….
এবার ছোট্ট করে আসি ” বিনোদন ” বিভাগের কিছু কথা নিয়ে।
কবি কালিদাস বলেছিলেন, ” পিশাচকেও ভোজন দ্বারা বাগে আনা যায় ” মনকে বশ মানানোর যাদুকরটি হলো হেঁশেলের অধিশ্বর। হাতের ছোঁয়া যৎসামান্য আয়োজনেই রাজপ্রাসাদের স্বাদ এনে দিতে পারে, আবার আটপৌরে স্বাদও হয়ে ওঠে অমৃত। ২০০৪ থেকে উৎযাপিত হয়ে চলেছে আন্তর্জাতিক রন্ধন শিল্প দিবস। গত কয়েকদিন আগে দিনটি ছুঁয়ে গেল আমাদের। এ-ই উপলক্ষ্যে বিনোদন বিভাগে নতুনভাবে সংযোজন করা হলো রন্ধনশালার খবরাখবর।
শুভ শারদীয়া শুভেচ্ছা ভালোবাসা… নিয়মিত নিয়ম মেনে উৎসবমুখর দিনগুলো কাটুক আমাদের সকলের এই কামনা করি।
গীতশ্রী সিনহা , সম্পাদক বিনোদন বিভাগ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *