কথা দিয়েছিলাম —— বিক্রম ঘোষ

কথা দিয়েছিলাম ( গল্প ) 2nd October প্রকাশিতর পর

বিক্রম ঘোষ

খিচুড়ির প্রসঙ্গ ওঠায় বিমলের মনটা চলে গেল তার ফেলে আসা অতীতে কেমন যেন অতর্কিতে। তার ইউনিভার্সিটি জীবনের দিনগুলোয়। সিক্সথ ইয়ারে বন্ধুদের সঙ্গে পৌষমেলায় শান্তিনিকেতনে যাওয়া আর কোপাইয়ের পাড়ে একদিন সকলে মিলে চড়ুইভাতি. করা। ওহ, সে সব কবেকার কথা। নিশ্চিন্ত জীবনযাপনের দিনগুলো। যে দিনগুলো গেছে সেগুলো কি একেবারেই গেছে, আর কোনদিন ফিরবে না! হারিয়ে যাওয়া কত কথাই যেন একসঙ্গে ভিড় করে এল বিমলের মনে।
হঠাৎ অপর্ণার কথা কানে আসতেই ভাবনায় ছেদ পড়ল, ‘তখন থেকে দেখছি অন্যমনস্ক হয়ে রয়েছ, ব্যাপারটা কী? কী ভাবছ এতো?’
নিজের মনটাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে বিমল একটুও সময় নেয়নি। জানাল, ‘না, পাড়ার ছেলেরা এসেছিল এই তোমরা জাস্ট ফেরার একটু আগে, পুজোর ব্যাপারে। একটা ঝামেলা পাকিয়ে দিয়ে গেছে।’
‘কী ঝামেলা পাকালো আবার?’
‘ ওদের পুজোর পত্রিকায় এবার শুধু সম্পাদকীয়তে চলবে না, আমার একটা গল্পও নাকি চাই।’
অপর্ণা হাসল। বলল, ‘ভালই তো, তবু অন্যরকম কিছু একটা করা হবে। সারাদিন তো শুধু শুয়ে বসেই কাটাও। এবার নাহয় ওই বাকি দুটো প্রবন্ধের সঙ্গে একটা গল্প লিখবে। ব্রেনটার একটু এক্সট্রা এক্সারসাইজ হবে।’ অপর্ণা যে বিমলের লেখার ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল, বুঝতে পারা যায়।
অধ্যাপক মানুষ বিমল। সহজে হার মানতে রাজি না। মুচকি হেসে জবাব দেয়, ‘সেটা অবশ্য তুমি মিথ্যে বলোনি। তবে, শুয়ে বসে যে কলম চালাই সেটার কথা বললে না। এমনটা কি উচিত হলো, গিন্নি?’
ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা যায় অপর্ণার। যুক্তিতে ও কোনোদিনই বিমলের সঙ্গে পেরে ওঠেনা। তর্ক দীর্ঘায়িত না করে হাসতে হাসতেই বলে, ‘থামো। সারাজীবন ছাত্র ঠেঙিয়ে উচিত অনুচিত যে ভালই জানো, সেটা আমারও জানা আছে। এখন শোনো, যা বলতে এসেছিলাম, অসময়ে হলেও বৃষ্টির ভেজা ভেজা হাওয়ায় একটু চা খেতে ইচ্ছে করছে। তুমি খাবে?’
‘অবশ্যই।’ বিমল অপর্ণাকে এই কিছুক্ষণ আগে তার কফি খাওয়ার কথা আর বলল না।
চা খেতে খেতে অপর্ণার সঙ্গে কাছাকাছি কোথাও সপ্তাহখানেক ঘুরে আসার কথাটাও উঠল। লেখার যা ভীষণ চাপ যাচ্ছে তাতে বেড়িয়ে এলে কিছুটা হালকা বোধ করবে সে। অপর্ণার ইচ্ছে পুরী বেড়িয়ে আসার। কিন্তু পুজোটা তার কলকাতায় কাটানো চাইই চাই।
চা শেষ করে কাপ দুটো নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল অপর্ণা। সাড়ে আটটা বেজে গেছে। ন’টা, সওয়া ন’টা নাগাদ রাত্রের খাবার অভ্যেস। হরির সঙ্গে হাত লাগালে বোধহয় একটু তাড়াতাড়িই হবে।
সময়মতো শুয়ে পড়লেও ঘুম এল না বিমলের। পুরনো বন্ধুদের কথা, ইউনিভার্সিটির দিনগুলো, শান্তিনিকেতনের স্মৃতি, সব কেমন যেন ওলটপালট করে দিচ্ছিল মনটাকে। ত্রিশ বছর না কি পঁয়ত্রিশ? কোথায় কে যে এখন, কে জানে! কারুর সঙ্গেই আর তেমন যোগাযোগ নেই।
অপর্ণার ঘুমটা একটু গাঢ় হতেই সন্তর্পণে পা টিপে টিপে বেডরুম থেকে বেরিয়ে এল বিমল। পাশের ঘরে এসে দরজাটা আস্তে করে ভেজিয়ে দিল। দ্বিতীয় বেডরুমটাই এখন তার স্টাডিরুম।
কোনও শব্দ না করে চেয়ারে বসল বিমল। বৃষ্টি আর নেই। বাইরের আবছা আলো ঘরের মধ্যে হালকা করে করে ছড়িয়ে পড়েছে। চোখ দুটো অন্ধকারে সয়ে যাওয়ার পর চারিদিক দেখতে আর অসুবিধা হলনা। বিমল মোড়াটার ওপরে পা দুটো তুলে দিয়ে মাথাটা পিছনে হেলিয়ে দিল। আর এক মুহূর্তে পৌঁছে গেল ইউনিভার্সিটিরসেই দিনগুলোতে আবার। সব যেন তার চোখের সামনেই ঘটছে, এখনই, এই সময়ে।
বোলপুরের আকাশে বাতাসে যেন কী ছিল সেদিন। রাঙা মাটির দেশে রঙীন হয়েছিল মনটা। খিচুড়ি খেতে খেতে নানান আবোলতাবোল কথাবার্তা। হঠাৎ প্রতীক বলে উঠে, ‘এই শোন, চল না, আমরা একটা পত্রিকা বার করি।’
প্রতীক এটা কী বলল! যা শুনেছে, সেটাই কি বলেছে? শরীরী ভাষায় এমনই এক অভিব্যক্তি দেখা গেল সবার মধ্যে। আচমকা এমন একটা প্রস্তাব শুনে হতভম্ব ওরা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে প্রতীকের দিকে। একেই কি বলে ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’? স্থবির হয়ে গেছে সবাই। ওদের কোলাহল শুধু বারণ হয়নি, মুখের গ্রাসটাও মুখেই রয়ে গেছে। কেউই এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না। মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে একে অপরের আশ্চর্য্য হওয়াটা মেপে নিতে চাইছিল। প্রশ্নটা শুনে বিমলও কম আশ্চর্য্য হয়নি। ভেসে বেড়ানো এলোমেলো মনটাকে গুটিয়ে আনতে সময় লাগছিল বিমলের।প্রতীকের প্রস্তাবের ব্যপ্তিটা তখনও ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছিল না।
সুজয় প্রথম নীরবতা ভাঙল। খানিকটা ব্যজ্ঞাত্মক ঢঙে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল প্রতীকের দিকে, ‘রবিঠাকুরের দেশে এসে সাহিত্য করার ভূত চেপেছে নাকি তোর মাথায়? বলা নেই, কওয়া নেই, দুম করে একটা কথা বলে দিলি। তোর মাথায় এমন উদ্ভট চিন্তা কে ঢোকাল? কী ভেবেই বা কথাটা বললি? তুই কি ক্ষেপেছিস, তোর কি মনে হয় আমরা উপযুক্ত?’
মানিক, প্রতীকের সব কথাই শুনেছিল কিন্তু কোনো মন্তব্য করেনি। গুরুগম্ভীর বিষয়ে ও কোনোদিনই বিশেষ মাথা গলায় না। বন্ধুদের সঙ্গে হাসি ঠাট্টা করাটাই ওর প্রথম পছন্দ এবং সেই কারণেই আসা। সময় কাটাবে তাদের সঙ্গে মশকরা করে। সুজয়ের কথা শেষ হতেই মানিক টিপ্পনি কাটে, ‘খিচুড়ির কারণে ওর বায়ু উর্দ্ধগতি প্রাপ্ত হয়েছে।’ বিমলের মনে হলো, কথার পরিপ্রেক্ষিতে এমন সরস মন্তব্য ওর মতো রসিকজনের পক্ষেই সম্ভব। বোলপুরে মানিকের উপস্থিতি ওদের বাড়তি পাওনা।
সুজয়ের প্রশ্নবাণ, মানিকের তির্যক মন্তব্য, এসব কোন কিছুতেই প্রতীক দমে যায়নি। বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়নি। ও জানত, ওকে এমন নানান বাধার মুখোমুখি হতে হবে, দমিয়ে দেবার চেষ্টা হবে। মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। নিজের ঐকান্তিক ইচ্ছেটা বন্ধুদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে গলার স্বরের গভীরতা বাড়িয়ে বলতে লাগল, ‘দ্যাখ, আমরা বাংলাভাষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পড়াশুনা করছি। একটু হলেও কিছুটা জ্ঞান অর্জন করেছি, নিজেদের মতো করে, নিজেদের ভাষায়, কিছু অন্তত লিখতে পারি। তাহলে, পুঁথিগত বিদ্যাকে কি কেবল পরীক্ষার খাতাতেই সীমাবদ্ধ রাখব? কোনও উপায়ই কি থাকবে না আমাদের অর্জিত শিক্ষা বিকশিত করার?’ কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে একটু থামল প্রতীক। বিমল লক্ষ্য করল ওর বুকের ভের জমে থাকা হতাশা এক দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এলো। কেউ একটা শব্দও করেনি – একেবারে পিন ড্রপ সাইলেন্স। অপার নিঃস্তব্ধতার মধ্যে তখন শুধুই শুকনো পাতার খসখস আওয়াজ।
এক গভীর শ্বাস নিয়ে প্রতীক আবার নতুন উদ্যমে বলতে শুরু করল, ‘আমার মনে হয়, সেটা একমাত্র নিজেদের চেষ্টায় পত্রিকা প্রকাশ করার মধ্যে দিয়েই সম্ভব। এছাড়া অন্য কোনও পথ আছে বলে তো মনে হয় না। নামী পত্রিকায় লেখা পাঠালে, বুঝতেই তো পারছিস, অনেক লেখার ভিড়ে সেসব হারিয়ে যাবে, বড়জোর পরের ডাকে ফেরত। তাই…’ বলেই চুপ করে যায় প্রতীক।
পূর্ব প্রকাশিতর পর। ( ক্রমশ )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *