অনামিকার ডায়েরি ——– মিলি মজুমদার

#গল্পহলেওসত্যি

অনামিকার ডায়েরি

মিলি মজুমদার
*********
আজথেকে অনেক বছর আগের কথা। বাংলা দেশের মুক্তি যুদ্ধ চলছে। তখন যথাসম্ভব তৃতীয় শ্রেণী তে পড়ি। এক গরমের দুপুরে জানতে পারি এক মহিলা বাংলা দেশ থেকে এখানে আসার পথেই স্বামীকে হারিয়ে ফেলেছে।আমরা তখন নৈহাটি থাকি।দুপুরে দাদাদের ক্লাবঘরের কাছে এসে খুব কান্নাকাটি শুরু করে দেয় ঐ মহিলা।খুবই নিম্ন বিত্ত পরিবার প্রকাশ পাচ্ছে তার কথায়। হাতে কানাকড়িও নেই।যেটুকু আছে তা তার স্বামীর কাছে। আছে শুধু কোলে তার কুচকুচে কালো গোলগাল বছর দেড়েকের একটা বাচ্চা মেয়ে আর একটা কাপড়-চোপড়ের বোঁচকা আর মহিলার নিটোল শরীর।আমি আর আমার প্রাণের বন্ধু শিখা তখন বড়দের সব আলোচনা যতোনা শুনছি, দেখছি মন দিয়ে। ক্লাবের বড়রা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় আপাতত পাড়ার পুটুদিদের পরিতক্ত বাড়িতে যতোদিন না স্বামীর সাথে যোগাযোগ হয় ততোদিন থাকবে ঐ মহিলা আর যার যেমন সামর্থ্য সে তেমন সাহায্য করবে। তাছাড়া কাজের বিনিময়ে বাড়তি কিছুও পাবে।তার বাচ্চা মেয়েটার নাম হাসি।সত্যিই নামটা রাখা সার্থক । মুখে সবসময় হাসি লেগেই আছে।পোড়ো বাড়িটা আমাদের বাড়ির কাছেই। প্রথমে আমাদের বাড়িতে আনা হোলো হাসিদের দুপুরে স্নান খাওয়ার জন্য। আমি তো তখন আনন্দে গদগদ। হাসিকে একটু কোলে নেবার জন্য। মা সর্ষের তেল দিলেন একটা ডাঁটভাঙা কাপে। হাসিকে তেল মাখিয়ে বোঁচকা থেকে গামছা বের করে জলে ভিজিয়ে কি সুন্দর নরম হাতে মুছিয়ে দক্ষিণের বাইরের বারান্দায় এক পাশে হাসিকে শুইয়ে হাসির মা গেল পথের সব ক্লান্তি ধুতে আমাদের পুকুরে। আমি নিজে থেকেই দায়িত্ব নিলাম হাসিকে পাহারা দেওয়ার। খালি গা গোলগাল চেহারা হাতে পায়ে খাঁজ। যেন জ্যান্ত মা কালি আমার হাতের নাগালে। মা খুব যত্ন করেই ভাত বেড়ে দিলেন। হাসির মা একপেট খিদে আর দুচোখের জল সহ খাওয়া শেষ করলো। দুপুরে আমাদের বাইরের বারান্দাতে আচঁল বিছিয়ে গভীর ঘুমে মা মেয়ে। শেষ বিকেলে একে একে অনেকেই প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে গেল।কেউ খেজুর পাতার পুরোনো চাটাই কেউ কেউ বাড়ির বাড়তি বাসন। সবার কাছ থেকে যে টুকু না হলে নয় সব জোগার করল পাড়ার লোকেরা।বিকেলের মধ্যেই পুরোনো বাড়িটুকু পরিস্কার করে দিলো পাড়ার ছেলেরা আশেপাশের কিছু আগাছাও ছেঁটে দিল।আমার মা দিলেন মশারি বালিশ টুকটাক কিছু জিনিস পত্তর আর একখানা তেল ভরা হারিকেন।পাড়ায় যেন দুগ্গাঠাকুর এসেছে এমন গমগমে ব্যাপার। সন্ধের আগেই মা রুটি তরকারি আখের গুড় আর হাসির জন্য খানিক দুধ দিলেন। সবাই মিলেই হাসিদের নিয়ে গেল পোড়ো বাড়িতে। মায়েরা চিন্তিত মনে রাত কাটালেন। একা মেয়ে মানুষ কোলে ঐ টুকুন বাচ্চা। পরদিন ঘুম থেকে উঠে মায়ের কথামতো আমি শর্টকাটে মিনিট তিনেকের পথ দিয়ে সোজা হাসির কাছে। দেয়াল ধরে হাঁটছে হাসি, মুখে হাসি লেগেই আছে।কিন্তু হাসির চোখদুটো লালচে আর গায়ে জ্বর। মা ডাকছে এই খবর দিতে গিয়ে হাসিকে খানিক চটকে এলাম।সকালে পড়তে বসেছি এমন সময় হাসির মা আসায় আমার পড়া শিকেয়। টুকটুক করে হাসি আমার দিকে এগিয়ে আসে আর আমি এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম কখন একটু হাসিকে কোলে নেব।আমার বাবা ডাক্তার ছিলেন।হাসিকে সাথেসাথেই ওষুধ দিলেন। প্রথম প্রথম বেশ কদিন শুধু আমাদের বাড়িতেই কাজ করতো আর খাওয়া দাওয়া করতো হাসির মা। আমি তখন ঐ কদিন বন্ধুদের একপ্রকার বাদের খাতায় রেখে হাসির সাথে কাটাতাম বেশি সময়।জীবন্ত পুতুল খেলা। হাসির মায়ের সাথে সাথে আমিও তেল মাখাতাম কাজললতা থেকে কাজল পরাতাম কপালে বড় কালো টিপটা পরিয়ে ঘরের পাউডার থেকে একচিমটে এনে কাজলের টিপের উপর দিয়ে দিতাম।মা আমার এইসব দেখে মুখ টিপে হাসতেন আর আমিও বুঝে যেতাম এটা মায়ের প্রশ্রয় মাখা হাসি। ভীষণ মায়া হোতো ওদের দেখে। হাসির মা থেকে থেকে চোখের জল ফেলত আর মা বোঝাতেন তোমার স্বামীকে ঠিক খুঁজে পাবে কারণ পাড়ার বড়রা সব খোঁজখবর শুরু করেছে।সময় সময় অন্যান্য বাড়িতেও কাজ করতো হাসির মা। বাঁধাধরা কোনো কাজ ছিল না কোথাও যার যেমন দরকার মতো কাজ করাতো বিনিময়ে চাল আটা সবজি তেল পয়সা খাবার যে যেমন পারত দিত। এই ভাবেই চলতে লাগল হাসির মায়ের আধভাঙা জীবনের সংসার। এবার আমার কথায় আসি। আমার কাজ ছিল নিঃশব্দে চৌর্যবৃত্তি। দুপুরে বাড়ির সবাই যখন ঘুমিয়ে তখন শুরু হোতো আমার চুরি করা। বাড়ির মাসের মুদিখানার সব জিনিস থেকে কাটিং করে প্যাকিং করে থুড়ি তখন এতো ক্যারি ব্যাগ ছিলনা যত্রতত্র। আরে জামার কোঁচড় আছে কি করতে? পুরোনো খাতার পৃষ্ঠা কাগজের টুকরোতে করে ছোটো মুঠোয় যা উঠতো নিয়ে দে ছুট হাসির কাছে,গিয়ে দেখতাম ভাঙা ইট সাজিয়ে কাঠের উনানে হাসির মাএর রান্না করা।আমি মাঝেমাঝে জোর করে খুন্তি টা নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম আর হাসির মা নিচু স্বরে হাসিমুখে বলতো এবার ছাড়ো তোমার হাত পুড়ে যাবে। এ যেন জীবন্ত রান্নাবাটি খেলা আমার।ঐ একটু খুন্তি ধরা এ যেন চরম পাওয়া আমার কাছে। চুরি করে জিনিস দেওয়ার পরিবর্তে এই টুকু আদায় করা যেন আমার অধিকার। যদিও হাসির মা কিছুতেই নিতে চাইত না আমার আনা জিনিস ,আমি জোর করে দিতাম। একদিন আমার মা কে বলে দেয় আমার চুরি করে জিনিস দেওয়ার কথা। আমি তো ভয়ে কাঠ! আমি শুনছি খেয়াল করেনি হাসির মা। মা বললেন আমি জানিতো— তুমি আমাকে জানালে এটা তোমার সততা আর আমার মেয়ের লুকিয়ে জিনিস দেওয়াটা হোলো বোলে বেশ কিছু ভালো ভালো কথা বলেছিলেন মা আমার জন্য মনে পড়ছে না এখন সে সব কথা। এইভাবে মাস চারেক সময় কাটার পর হটাৎ করেই হাসির বাবা এসে হাজির। আবারো গমগমে পাড়া। এবার দুগ্গাঠাকুরের বর এসেছে। হাসির মার কান্না থামেনা। আমার ছোটো মাথায় ঢোকে না বর হারিয়ে কান্না আবার পেয়েও কান্না।আমার নরম মনটা কেমন যেন দুলে উঠল এখন আমার হারানোর পালা। এবার হাসিদের নিয়ে চলে যাবে ওর বাবা।আমার জ্যান্ত পুতুলখেলা আমার জীবন্ত রান্নাঘর সব সব শেষ। তারপর দিন কয়েক ছিল হাসিরা। সে কদিন আমি একবারের জন্য যাইনি হাসিকে দেখতে। কি এক অভিমান আমার উপর ভর করেছিল সেই কদিন। যাওয়ার আগেরদিন সব বাড়িতে দেখা করতে এসেছিল হাসিরা।আমাকে দেখে হাসি খুশিতে দুলে ওঠে তার মায়ের কোলে। কদিন যাইনি তাই বোধহয় দেখে অতো খুশি। হাসির মাএর তখন অন্য রূপ,বড় সিঁদুরের টিপ সিঁথি ভরা সিঁদুর চোখে মুখে ভরসার প্রসাধন। আমার কোলের কাছে হাসিকে বসিয়ে দেয়। আমি হাসির ছোটো ছোটো আঙ্গুল গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করি আর চোখ দুটোতে আমার নোনা জলের চোরা স্রোত।পরদিন সকালে ওরা তিনজন রওনা দিল নতুন করে ঘর বাঁধার জন্য। দুজনের মাথায় দুটো বোঁচকা আর হাসির মায়ের কাঁখের দুদিকে দুলছে হাসির পা দুখানা।এক অখণ্ড সভ্যতা এগিয়ে চলেছে খন্ড খন্ড পথে ——-

~~~~

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *