কথা দিয়েছিলাম বিক্রম ঘোষ

কথা দিয়েছিলাম
বিক্রম ঘোষ

—————–

শেষ দুপুর থেকেই অল্প অল্প মেঘ জমেছিল আকাশে। সন্ধ্যে হতে হতে সেটা যেন আরও ঘন হয়ে এলো। ভাদ্রের শেষ,পুজো খুব কাছাকাছি না হলেও খুব বেশি দিন বাকি নেই। উত্তর শহরতলীর বহুতল বাড়ি, ছ’তলার ফ্ল্যাট, তবুও কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার পাঁচটা বাজতে না বাজতেই। বাইরের আবহাওয়ার কারণে বেশ গুমোট আর দমবন্ধ লাগছিল বিমলের। জানালাগুলো খুলে দিয়ে, ফ্যানটা অল্প স্পীডে চালিয়ে, টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিল। কলেজ থেকে রিটায়ারমেন্টের পর আলস্য যেন দশগুণ বেড়ে গেছে। ভেবে, হাসি পেল বিমলের। এ সময়ে এক কাপ কফি হলে মন্দ হতো না। অপর্ণা বাড়িতে নেই, হরিও বাজারে গেছে কিছু সান্ধ্য কেনাকাটা করতে। অগত্যা নিজেকেই উঠতে হলো। রান্নাঘরের আলো জ্বালিয়ে মাইক্রো ওভেনে একটু কফি বানিয়ে নিতে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
কফির কাপটা নিয়ে স্টাডিরুমের টেবিলে এসে বসল বিমল। সন্ধ্যেবেলা তার বিশেষ কোনও কাজ থাকে না। কদাচিৎ কোনও অনুষ্ঠানে ডাক পড়লে সে আলাদা কথা। টিভিতেও দেখার মতো কিছু খুঁজে পায়না। মাঝে মাঝে হয়তো একটু খবর শোনা, একটু খেলা দেখা, ব্যস ওই পর্যন্তই।
হাতের সামনেই একটা বই – মোঘল আমল থেকে আরম্ভ করে ইংরেজ আমল অবধি বাংলার ভাঙা গড়ার ইতিহাস। বাঙালি জাতির ইতিহাস। বিদেশী লেখকের গবেষণামূলক বইটা। সহজ সরল ভাষায় লেখা। এই বইটা পড়তে বেশ ভালই লেগেছে বিমলের। প্রবন্ধ ধরণের বই পড়তে ও ভালোবাসে। দিন কয়েক আগে শুরু করেছিল, টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে সেটাই আবার খুলে বসল। শত কাজেও বইপড়াটা ওর নেশা। বাইরে কখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে খেয়াল করেনি বিমল। এখন ঝমঝম করে নামাতে চমকে উঠে বাইরের দিকে তাকালো। বারান্দাটা ভালই ভিজেছে। ঘরেও জলের ছাঁট। অনিচ্ছা সত্বেও উঠে কয়েকটা জানালা বন্ধ করতে হলো। এবার পুজোটা না ডোবায়। বর্ষাকালে বৃষ্টি নেই, শরতে বন্যা! কফির শেষ চুমুকটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। তাই সই। বইয়ের এই পর্বটা বেশ জমে গেছে। শেষ না করে ওঠা নয়।
হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজে মনঃসংযোগে চিড় ধরল বিমলের। একটু আগে দূরে লেক টাউনে বিগ বেনের ঘন্টার আওয়াজ কানে এসেছে বটে, কিন্তু গোনার কথা ভাবেনি। ঘরে তখনও ছায়া ছায়া অন্ধকার। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় কিছু কিছু গোচরে আসে। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল বিমল। সওয়া সাতটার মতো বাজে। এইসময়ে, কে আবার? বৃষ্টির মধ্যে কে হতে পারে? স্বগতোক্তি করে বিমল। অপর্ণা, হরি দু’জনেরই কাছে চাবি আছে। মনে মনে একটু বিরক্তই হলো। তবু ভদ্রতার খাতিরে দরজা তো খুলতেই হয়। অনিচ্ছাসত্বেও বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। বসার ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দরজাটা খুললো শেষ পর্যন্ত।
দরজার সামনে পাড়ারই তিন যুবক। অবশ্যই বিমলের পরিচিত; সৌম্য, রূপেণ আর মিহির। তিনজনই পাড়ার পুজো কমিটির সক্রিয় সদস্য। বিমল ভাবল সেই সংক্রান্ত ব্যাপারেই হয়তো কিছু আলোচনা করতে চায় এরা। ওদের ভেতরে এনে বসাল। তিনজনেই অল্পবিস্তর ভিজেছে, কিন্তু বিমল সে প্রসঙ্গ তুললো না, এ ব্যাপারে সে কিছু সাহায্য করতে পারবে না। অপর্ণা বাড়ি থাকলে হয়ত বা ভাবা যেত।
বিমল কিছু বলার আগেই তিনজনে এরকম হঠাৎ এসে উপস্থিত হবার জন্য ক্ষমা চাইল। বাড়ি থেকে আগেই বেরিয়ে পড়েছিল পথে বৃষ্টি, ইত্যাদি। বিমল বলল, ‘সে সব বাদ দাও, বলো, কী ব্যাপার? পুজোর সুভ্যেনিয়রের লেখা তো? সে তো প্রায় শেষ করে এনেছি। দু’একদিনের মধ্যেই পাঠিয়ে দেব।
‘প্রতি বছর পাড়ার পুজোর বার্ষিক পত্রিকার সম্পাদকীয় ‘আমাদের কথা’ লেখাটা বিমলই লিখে আসছে কয়েক বছর ধরে। বাংলার অধ্যাপক হওয়ার জের আর কী।
রূপেণ বলল, ‘না দাদা, ওটার কথা বলছি না।’ বিমল একটু অবাক হলো, ‘তাহলে?’ কথার খেই ধরে ওদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ মিহির উত্তর দিল, ‘দাদা, এবার যদি একটা গল্প লিখে দেন তাহলে আমাদের পাড়ার একটু মান বাড়ে। বুঝতেই তো পারছেন, আপনার মতো মানুষের লেখা পত্রিকায় ছাপা হলে বিজ্ঞাপন পেতেও সুবিধা হবে। খরচ দিনকে দিন যা বাড়ছে।’
বিভিন্ন পুজো সংখ্যায় বিমল যে মাঝে মধ্যে লেখে সেটা কারুরই অজানা নয়। কিন্তু সেটা আরও বৃহত্তর পাঠক সমাজের জন্য। এবং, এটাও অস্বীকার করা যায়না যে, তার জন্য কিছু পারিশ্রমিকও মেলে লেখকের।
বিমল খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমাকে দু’একদিন সময় দাও। একটু ভেবে দেখি।’
ওরা চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল। বিমলের লেখা পাওয়ার ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে দরজার দিকে যেতে যেতে সৌম্য বলল, ‘দাদা, আমরা তাহলে দু’একদিন পরে আবার আসব।’
বিমল বাধা দিল,’আরে না, না, তার দরকার হবে না। আমি নিজেই খবরটা পাঠিয়ে দেব। বুঝতেই তো পারছ লেখার চাপ অনেক দিক থেকেই আছে। এখনই কিছু প্রমিস করছি না কিন্তু।’ বিমলের কথায় সামান্য আত্মশ্লাঘা বোঝা গেল। তেমনটা হওয়ারই কথা, পাঠক সমাজে ওর স্বীকৃতি অস্বীকার করার নয়।
ওরা হেসে দরজার দিকে পা বাড়ালো। বিমল ওদের এগিয়ে দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে বসার ঘরে এসে বসল আবার।
এরকম একটা অবস্থার জন্য বিমল একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। বহুল প্রচারিত পত্রিকার দুটো লেখা সে আগেই পাঠিয়েদিয়েছে, বাকি অন্য দুটো পত্রিকার লেখা প্রায় শেষ করে এনেছে। ভেবেছিল ও দুটোও খুব শিগগিরই পাঠিয়ে দিয়ে এবার পুজোর আগেই অপর্ণার সঙ্গে কাছাকাছি কোথাও বেড়িয়ে আসবে। এদের আবদারে তা বোধহয় আর হয়ে উঠবে না। ওদের ধারণা, লিখতে বসলেই যেন গড়গড় করে লেখা বেরিয়ে আসে। লেখার পিছনে যে কতটা অধ্যবসায়, কতটা একাগ্রতা প্রয়োজন, সেটা বোঝে না।
এইসব ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল বিমল। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে চমক ভাঙল। অপর্ণা এসেছে, সঙ্গে বাজারের ব্যাগ হাতে হরিও। দু’জনের হাতেই ভেজা ছাতা। বসার ঘরে বিমলকে বই বা অন্য কোনও কাজ ছাড়া একাকী চুপচাপ বসে থাকতে দেখে অপর্ণা একটু অবাকই হলো। ওকে এভাবে দেখতে অভ্যস্ত নয় সে। কারণটা জানতে চায়নি, শুধু নিজের ইচ্ছেটা একটু হেসে বিমলকে জানাল, ‘পথে হরির সঙ্গে দেখা। বললাম, রাত্রে খিচুড়ি করলে কেমন হয়। খাবে?
বিমল বেশ খুশি হয়েই বলল, ‘হয়ে যাক তাহলে। সঙ্গে কী? ডিম, না মাছ ভাজা?’
ত্রুমশ…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *