#গল্প : #অনুরণন : @ পাপিয়া
#গল্প :
#অনুরণন :
@ পাপিয়া।
~~
এলার্মের আওয়াজে কোনোমতে আধবোজা চোখটা খুলে সময়টা দেখে নিয়ে আবার ঘুমকে জড়িয়ে বালিশে মাথা রাখলো তিস্তা। এখনো পনেরো মিনিট শুতে পারবে। ইচ্ছে করেই আধ ঘন্টা সময় এগিয়ে রেখে এলার্মটা দিয়েছিল কাল রাত্রে। আসলে কোনোদিনই ঘুম থেকে একবারে উঠতে পারে না তিস্তা। একটু শুয়ে আরাম করা তার চাইইইই….
পনেরোর যায়গায় কুড়ি মিনিট হয়ে যাবার পর তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হতে যাবার আগে মা’কে বললো ব্রেকফাস্ট রেডি করতে। বেবি পিঙ্ক শাড়ি, ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিক, আর চোখে সানগ্লাসে তিস্তাকে যেন আজ লাগছে অপরূপা। এমনিতেই খুব একটা সাজগোজ পছন্দ করে না সে। অনেকে তাকে গ্ল্যামার কুইনও বলে ডাকে। সে সব গায়েও মাখে না তিস্তা।ব্রেকফাস্ট করেই সে গাড়ির চাবিটা নিয়ে বেড়িয়ে গেল। তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে এয়ারপোর্টে….
প্রায় চারমাস পর দেখা হলো অনিকেতের সঙ্গে। দুজনেই খুশির আবেশে আত্মহারা…
কলকাতায় বদলি নিয়ে বরাবরের মত চলে এলো, এবার নিশ্চিন্ত। রাস্তায় আসতে আসতে দুজনেই একমত হয়ে ঠিক করলো ; সামনের ফাল্গুনেই বিয়েটা সেরে ফেলবে। আর দেরি করা যাবে না। বাড়ি ফিরতেই মা, বাবা খুব খুশি অনিকেতকে দেখে। আরও খুশি ওর বদলির খবরটা শুনে। অনিকেতের বাড়ি পুনে।চাকরি করতো দিল্লি তারপর ব্যাঙ্গালোরে আর এখন কলকাতা। তিস্তাদের বাড়িতে আসার কারণ কোয়ার্টার একটু দূরে, তাই সেখানে যাবার আগে তিস্তার বাবা মা’য়ের সাথে দেখা করে যাবার ইচ্ছেতেই এখানে আসা।
জমিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজের মাঝে বিয়ের কথাটা সেরে ফেললো অনিকেত। তিস্তার বাবা মা রাজি আর অনিকেতের বাড়ির সকলে রাজি ছিল আগে থেকেই। শুধু বাকি রইল দু বাড়ির একসাথে হওয়া আর তারিখটা ফাইনাল করা। মাস দেড়েক পরেই দুর্গাপূজা, তাই পরের দিন দুজনেই বেড়োলো বিকেলে পুজোর মার্কেটিং করতে, ফিরলো অনেক কেনাকাটা করে নানান প্যাকেট সহ রাতের খাবার খেয়ে। কিছু প্যাকেট নিয়ে তিস্তা উঠে আসে ওপরে, কিন্তু অনির (অনিকেতকে তিস্তা “অনি” বলে ডাকতো।) দেরি হচ্ছে দেখে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে গিয়ে ব্যালেন্স হারিয়ে গড়িয়ে পড়ে বারোটা সিঁড়ির নিচে…..
বাকি প্যাকেটগুলো আনতে অনিকে সাহায্য করার জন্যেই এতো তাড়াহুড়ো করে নামতে গেছিলো।
তারপর, সকলের সব রকম চেষ্টা ব্যার্থ করে কোমর থেকে পা পর্যন্ত অকেজো তিস্তা আজ শয্যাশায়ী….
অনিকেত আসতো দেখা করতে মাঝেমধ্যে।
দিন পনেরো পর হসপিটাল থেকে হুইলচেয়ারে বাড়ি ফিরলো তিস্তা।
বাড়িতে আসার পর থেকেই ধীরে ধীরে একা হতে লাগলো মেয়েটা। বাবা, মা যতটা সম্ভব সাথ দিতেন,কিন্তু ব্যস্ততা বেড়ে গেল শুধু অনিকেতের। তাকে দেখতে এসেও দু একটা কথা বলার পরই মোবাইলে ব্যস্ত থাকতো অন্য কন্ঠস্বরের সঙ্গে, মাঝে মাঝে সে শব্দ তিস্তার কান পর্যন্ত পৌঁছে যেত। অনিকেত যে তার পাশে বসেই কথা বলতো। তাই তার বুঝে নিতে অসুবিধা হয় নি অন্য নারীর কন্ঠস্বরকে… একথা কাউকেই বুঝতে দেয় নি তিস্তা। শুধু এটুকু বুঝেছিল,সে আজ করুণার পাত্রী। আগলে রাখা হাতে ;মৃত্যু ঘটেছে ভালোবাসার।
অসহায় শরীরটা বড্ড বোঝা হয়ে যাচ্ছিল দিনকে দিন। পোড়া গন্ধে ভরে উঠেছিল মনের আনাচ কানাচ…
অনি হারিয়ে যাচ্ছিল চোখের সীমানার বাইরে একটু একটু করে। বুঝেছিল, এই পঙ্গু মেয়েটা মেটাতে পারবে না তার কোনো খিদেই কোনোদিনই….
তাই প্রতিদিনের কষ্ট গিলে তিলে তিলে বদলে ফেলেছিল তিস্তা নিজেকে।
আজ মহালয়া। ক’দিন পরেই পুজো। চারিদিকে বেশ পুজো পুজো গন্ধ। সবটা মিলে অন্যরকম ভালোলাগা। তিস্তার চোখ জানলার ফাঁক দিয়ে আকাশটার দিকে…
হঠাৎ মায়ের চিৎকারে হুঁশ ফিরলো তিস্তার।
কার নাম ধরে যেন ডাকছে, তাকিয়ে দেখে ছোটবেলার বন্ধু প্রবুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে তার খাটের পাশে। একেবারে ভুত দেখার মত দেখে চমকে উঠে বললো.. তুই..? এখানে? কবে? কখন এলি? একগাল হেসে, তারপর কত অভিযোগ… সে এখানে কবে এলো, কেন তাকে না জানিয়ে এলো, কেন সে বছরখানেক কোনো যোগাযোগ রাখে নি, আরো কত কি।
একসাথে ডাক্তারি পড়ার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল তিস্তার।কত আনন্দ করতো ওরা। সবাই একসাথে হাতে হাত রেখে পেরিয়েছে পাঁচ পাঁচটা বছর। তারপর ধীরে ধীরে ছোট হতে থাকে যোগাযোগের পরিধি। পরে জানতে পারে প্রবুদ্ধ বিদেশে আছে। অনলাইনে মাঝে মাঝে যোগাযোগ হতো। সেই মানুষ আজ চোখের সামনে। প্রথমে বিশ্বাসই হচ্ছিল না….
প্রবুদ্ধ সবটা জেনেই এসেছিল তিস্তার সঙ্গে দেখা করতে। জানিয়েছিল তিস্তার মা। সে আজ অনেক নাম করা নিউরো অর্থোপেডিক্স ডাক্তার।
তিস্তার সব কথার উত্তর শান্ত মাথায় দিয়ে প্রবুদ্ধ একটা অনুরোধ করে তিস্তাকে, যাতে সে একবার অন্ততঃ চিকিৎসার শেষ চেষ্টা করার সুযোগ দেয়। তিস্তা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও বিফল হয়ে শেষমেশ রাজি হয় । বছর দুয়েক বিদেশে থাকার দরুন কিছু অভিজ্ঞতা আর বিশ্বাসের জোরে তিস্তাকে ভালো করার জেদ চেপে বসলো প্রবুদ্ধের মনে। সেদিনই সে ঠিক করে, বিদেশে নিয়ে যাবে তিস্তাকে। তারজন্যে যা কিছু করার সবটা করবে।
তাই বিদেশে রিপোর্ট পাঠানো, ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা, নিজে কেস স্টাডি করা থেকে আরম্ভ করে সবটাই সামলাতে ব্যস্ত থাকে প্রবুদ্ধ।
এদিকে অনিকেত খোলাখুলি জানিয়ে দেয় যে তার মা অন্য এক মেয়ের সাথে তার বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন, তাই সে নিরুপায়…
ফোঁটারাও বোধহয় বিদ্রোহ করেছিল সেদিন, তাই বেড়িয়ে আসে নি চোখের কোণ ঘেষে। শুধু কেঁপে উঠেছিল দুটো ঠোঁট।
দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেলো মহা সপ্তমী। অষ্টমীর দিন সকালে অঞ্জলি দেবার জন্যে অনেক অনুরোধ করেন তিস্তার মা কিন্তু রাজি হয় নি তিস্তা। মা’কে শুধু এটুকুই বলেছিল, “বন্ধ চোখে দর্শন করতে চাই মা দুর্গার মুখ। দেখতে চাই অন্তর্দৃষ্টি খুলে। যদি কোনদিন পায়ে হেটে যাবার ক্ষমতা তিনি দেন সেদিন যাবো সশরীরে তাঁকে দর্শন করতে হুইলচেয়ারে করে নয়”। আরো বলেছিল, এবার দুর্গা নিজে আসবে তার কাছে। মুচকি হেসে কষ্ট গিলেছিল একা….
এরপর চোখ বন্ধ করে অনুভব করে মা দুর্গার মুখ, প্রণাম করে মনে মনে আর অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, লড়াই করার শক্তি দিও মা, সকলের মঙ্গল কোরো, অনিকেও ভালো রেখো।
অক্টোবরের ২৩ তারিখ তিস্তার যাত্রা বিদেশের পথে। অনির বিয়ের দিনও সেদিনই…
২৮ তারিখ অপারেশন। সমস্ত টেষ্ট কমপ্লিট। সারে ছয় ঘন্টার অপারেশন। ওটিতে ঢোকার আগে মায়ের হাতটা ছুঁয়ে বলেছিল, ফিরে আসবো আবার। ভেবো না। দরজা বন্ধ।
লাল আলো জ্বলজ্বল করছে মাথার ওপর।
প্রায় টানা সাত ঘন্টা অপারেশনের পর ডাক্তার জানালো এমনিতে সব ঠিক আছে, বাকিটা……
দুদিন পর বাড়ির লোকেদের দেখতে পেয়ে চিকিচিক করে উঠেছিল তিস্তার চোখ। প্রবুদ্ধ নিজেও ছিল সেদিন ওটিতে। তাই সে বিশ্বাসের জোরে বলেছিল ” দেখিস,তুই আবার আগের তিস্তা হয়ে যাবি।” হেসেছিল সেদিন তিস্তাও তবে সেটা ছিল অবিশ্বাসের হাসি।
কিছুদিন পর থেকে শুরু হয় ফিজিওথেরাপি,আর তার সঙ্গে প্রবুদ্ধ দিয়ে যেত মানসিক উৎসাহ। বারবার বলতো,”তিস্তা তুই পারবি, তোকে পারতেই হবে। তোকে হারতে দেবো না।”
সারাক্ষণ এই কথাগুলো মাথার ভেতর ঘুরপাক খেত আর সেখান থেকেই অসম্ভব মানসিক জোর পেত তিস্তা।
ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকে তিস্তা। পা রাখে মাটির বুকে। অসম্ভব মনের জোর আর চরম কষ্টকে সঙ্গী করে হাঁটতে শুরু করে কোনো সাহায্য ছাড়াই। ফিরে আসে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে মাস তিনেক পর। প্রবুদ্ধ বলে, কি রে? বলেছিলাম না? তুই আবার আগের তিস্তা হয়ে যাবি। তিস্তার মুখে তৃপ্তির হাসি। শুধু একটা কথাই বলেছিল, ” তুই আমার কে রে” বন্ধু? না ঈশ্বর? ” প্রবুদ্ধ উত্তরে হেসে বলেছিল শুধু “বন্ধু”।
কিছুদিন পর হসপিটালে চাকরি পায় নিউরোলজিস্ট ডঃ তিস্তা মুখার্জি। সেখানে প্রবুদ্ধ ওর সিনিয়র। দিন কেটে যাচ্ছিল ভালোই। তিস্তাও মন দিয়ে সেবা করে যাচ্ছিল মানুষের।একদিন চেম্বার শেষ করে বেড়োতে যাবে এমন সময় নার্স এসে খবর দেয় একটা ইমার্জেন্সি কেস এসেছে। পেশেন্টকে ভেতরে নিয়ে আসতে বলে চেয়ারে বসতেই ;তিস্তা দেখলো দরজা ঠেলে এগিয়ে আসছে একটা হুইলচেয়ার , সেই চেয়ারটায় বসে আছে অনিকেত…..
সঙ্গে অনির মা ও স্ত্রী।
কিছুক্ষণের জন্যে শূন্য হয়ে গেছিল মাথার ভেতরটা, তারপর নিজেকে সামলে শুরু করে চিকিৎসা। ভেতরে ভেতরে বারবার বলতে থাকে “তুমি একজন ডাক্তার”…কোনো ইমোশন তোমায় মানায় না।
অনি শুধু একটা শব্দই সেদিন উচ্চারণ করেছিল “ক্ষমা”…যা অনুরণন হয়ে আছড়ে পড়েছিল তিস্তার অতীতের বারান্দায় ….
হসপিটালের বাইরে কারা যেন বলছিল, সদ্য বিয়ে হওয়া স্বামী,স্ত্রী মধুচন্দ্রিমা করতে গেছিল পাহাড়ে। সেখান থেকে ফেরার পথেই এক্সিডেন্ট আর ভদ্রলোক এখন হুইলচেয়ারে….
এই কথাগুলো কানে আসতেই বন্ধ হয়ে এসেছিল চোখের পাতা। সেদিন আর আটকে রাখতে পারে নি ফোঁটাদের;অঝোরে ঝরেছিল নীরবে…..
এরকম তো চায় নি তিস্তা। কোনোদিনই না.. অবচেতনেও না… সে তো তাদের মঙ্গল কামনাই করেছিল ঈশ্বরের কাছে।
তবুও কেন? সবই কি অন্তর্যামীর খেলা?
হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরে আসার পথে তিস্তার মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথের লেখা রথযাত্রা কবিতার কিছু লাইন..
“রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে ‘আমি দেব’, রথ ভাবে ‘আমি’,
মূর্তি ভাবে ‘আমি দেব’—হাসে অন্তর্যামী”—-
দূর থেকে ভেসে আসছিল ঢাকের আওয়াজ। আজ যে মায়ের বোধন….
এবারে তিস্তা মা দুর্গার দর্শন করবে নিজের পায়ে হেটে,কোনো হুইলচেয়ারে নয়….