ইতিহাসের আলোকে কিরাত ভূমি —– গৌতম নাথ

ইতিহাসের আলোকে কিরাত ভূমি
গৌতম নাথ

উত্তর-পূর্ব ভারতে অবস্থিত ত্রিপুরা একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন রাজ্য। ব্রিটিশ আমলে ত্রিপুরা ছিল একটি দেশীয় রাজ্য। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা রাজ্য ভারত ইউনিয়নে যোগদান করে। ত্রিপুরার রাজা পরিচিত ছিলেন ‘মাণিক্য রাজা’ নামে। ব্রিটিশ যুগের পূর্বে কিছুকাল বাংলাদেশের কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেটের অংশ বিশেষ, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং আরাকানের আকিয়াব প্রদেশ ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যুক্ত ছিল। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানী লাভ করলে ত্রিপুরা রাজ্য পাহাড়ি এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়।

ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে চার ধরণের মত প্রচলিত আছে। প্রথমত, রাজমালাসহ সমসাময়িক গ্রন্থাদি মতে মহাভারত যুগে রাজা যযাতি নামে একজন পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন। রাজা যযাতির অবাধ্য পুত্র দ্রুহ্য পিতা কর্তৃক স্বীয় রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে গঙ্গা ও সাগরের সঙ্গমস্থল ‘সাগর দ্বীপে’ নির্বাসিত হন। রাজা দ্রুহ্যের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দৈত্যরাজ সিংহাসন আরোহণ করেন। মহারাজা দৈত্যের পুত্রের নাম ত্রিপুর। এই রাজা ত্রিবেগ থেকে উত্তর পূর্ব দিকে ধাবিত হয়ে কিরাত রাজ্য অধিকার করেন এবং ত্রিবেগ ও কিরাত জনজাতির মাঝে মহামিলন ঘটান। ত্রিপুর রাজা তাঁর বিজিত রাজ্যের নামকরণ করেন ত্রিপুরা এবং প্রজাদের নামকরণ করেন ত্রিপুর জাতি। দ্বিতীয়ত, ত্রিপুরী ঐতিহাসিকদের অনেকে মনে করেন অতীতে বর্মণক (আরাকান), চট্টল (চট্টগ্রাম) ও কমলাঙ্ক (কুমিল্লা) এই তিনটি প্রদেশ সমন্বয়ে ত্রিপুরা রাজ্য ছিল এবং উল্লিখিত তিনটি প্রদেশে বৃহৎ তিনটি পুর (নগর) ছিল এবং এই থেকে ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি হয়েছিল। তৃতীয়ত, ত্রিপুরীগণের মাতৃভাষার নাম ‘কক বরক’। কক বরকে জল বা নদীকে বলা হয় ‘তোয়’।
আর মোহনাকে বলে ‘প্রা’। তোয় ওপ্রা শব্দ থেকে ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি। চতুর্থত, বিষ্ণু পুরাণ গ্রন্থে আছে ভারত সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রান্তরে কিরাতের বাস। কামরূপ (আসাম) ও রাক্ষ্যাং (আরাকান) প্রদেশের মধ্যবর্তী ভূ-ভাগকে আর্যরা সুম্ম বা সুহ্ম নামে আখ্যায়িত করেন। টিবেটো বর্মণ শান বংশীয় জনগোষ্ঠী সেখানে শক্তিশালী রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। এই রাজ্যটিই মহাভারত গ্রন্থে ত্রৈপুরা, কখনো বা ত্রৈপুরী নামে আখ্যায়িত হয়। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ৬২০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ভারত ভ্রমণ বিবরণীতে সমুদ্র উপকূলবর্তী সমতট (বঙ্গদেশ) নামক দেশের উত্তর পূর্বে ত-ল-পো-তি (To-lo-po-ti) নামে একটি রাজ্যের উল্লেখ করেছেন, যাকে ত্রিপুরার সমার্থক বলে মনে করা যেতে পারে। নির্ভরশীল তথ্যের অভাবে কোন মতকেই গ্রহণও করা যায় না, আবার বর্জনও করা যায় না। তবে এটা সত্যি যে, ত্রিপুরা একটি অতি পুরনো রাজ্য।

নৃতাত্ত্বিক বিচারে ত্রিপুরা জাতি মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভুত। মঙ্গোলীয়রা প্রায় ৫ হাজার বছর আগে মঙ্গোলিয়া থেকে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে আগমন করেছিল। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর একটি অংশ পরিচিত ছিল বোডো (Bodo) বা বরো (Boro) নামে। পূর্ব ভারতে আর্যদের আগমনের পূর্বে এই বোডো বা বরো জনজাতি এখানে আধিপত্য কায়েম করেছিল। রামায়ণ ও মহাভারত সূত্রে জানা যায় ভারতবর্ষের উত্তর পূর্বাঞ্চল রাজ্যসমূহ বোডো বা বরো জনজাতির নৃপতি কর্তৃক শাসিত হতো। আর্যগণ তাদেরকে কিরাত, দানব ও অসুর নামে আখ্যায়িত করতো। এই বোডো বা বরো জনজাতির একটি শক্তিশালী দল গঙ্গানদী, শীতলক্ষা, ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী নদীর অববাহিকার বিস্তৃর্ণ ভূ-খন্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। (ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *