#রায় বাড়ির অন্দরমহল পর্ব–৬ ছবি ব্যানার্জী।

#ধারাবাহিক
#রায় বাড়ির অন্দরমহল
পর্ব–৬
ছবি ব্যানার্জী।

রায় বাড়িতে মানুষজন তো কম নেই।তবু একটা মানুষের অভাবে গোটা বাড়িটা যেন বড় ফাঁকা হয়ে গেল।বিশেষ করে শাশুড়িমার এই ঘরটা।

চুরানব্বই বছরের শাশুড়িমার জন্য শোকে ভেঙে পড়ার কোনো কারণই ছিল না পুটু সুন্দরীর। কিন্তু পুটু বোধহয় খানিকটা অনুশোচনায় কাতর হয়েছিল। এতবছর নীরবে শাশুড়িমার বশংবদ হয়ে সংসার করার পর শেষ সময়টাতে স্বামীর কাছে বিরক্তি ও ঝাঁঝটা না দেখালেই পারত।আরও তিন চারমাস শাশুড়িমা বেঁচে থাকলে এটা সে ও ভুলে যেত তার স্বামীও ভুলে যেত।কিন্তু সদ্য বিরক্তি প্রকাশ করার পর মানুষটা দশটা দিন ও বাঁচল না। কথাটা কি তার স্বামী মনে রাখবে? একে একে সবাই এই ঘর থেকে চলে গেলেও পুটু ঘরের মেঝেতে চুপ করে বসেছিল।
তাদের এখন অশৌচ চললেও দাহকাজ শেষ হলে বাড়ির আর সবাই তো কিছু খাবে সেসব ব্যবস্থা তারপর
দাহকাজ শেষ হলে বাড়ি ফিরলে কিছু নিয়ম থাকে তার ব্যবস্থাটুকু করতেও তার শরীর সায় দিচ্ছে না।সে শাশুড়িমার ঘরের মেঝেতে থম মেরে বসে থাকল।সেজ মেয়ে বিশাখা একটু পরে এসে মায়ের গা ঘেঁসে বসে বলল– মা তুমি একা একা এখানে বসে কি করছ?এসো দালানে বসো।পুটু বলল– এখানেই বেশ আছি।তুই বরং আমার কাছে একটু বস। হ্যাঁরে মা তোর কি ঠাকুমার জন্য কষ্ট হচ্ছে?বিশাখা বলল– মা ঠাকুমা আর বেশিদিন বাঁচলে খুব কষ্ট পেত। এত দীর্ঘ পরমায়ুও তো কেউ পায়না।ঠাকুমার মতো এমন যন্ত্রনাহীন সজ্ঞানে এমন মৃত্যু খুব কমজনেরই হয়।

পুটু বলল–তা ঠিক। আমিই শুধু শুধু ভেবে মরছি।হ্যাঁরে মা তুই শ্বশুর বাড়িতে ভালো আছিস তো?বাচ্চা হচ্ছেনা বলে শাশুড়ি কি তোকে কথা শোনায়?জামাই কিছু বলে?বিশাখা আনমনা হয়ে বলল–তোমার জামাই আমাকে খুব ভালোবাসে মা।কিন্তু–পুটু বলল–বল থামলি কেন?–না মা কিছু না।পুটু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল–সব পুরুষরাই ঘরের ভিতর বৌকে ভালোবাসে কিন্তু পরিবারের শত অন্যায় দেখলেও শামুকের খোলের মতো নিজেকে গুটিয়ে রাখে।তার এই মেয়ে দুটোর সংসারটা টিকবে তো? বিশাখা বলল–মা বাবারা ফিরলে বড়দি আর মেজদি যা নিয়ম আছে করে রেখেছে।তোমাকে এই কটা দিন কিছু দেখতে হবে না।আচ্ছা মা ললিতা শ্বশুর বাড়িতে কেমন আছে কখনও জানতে চেয়েছো?পুটু বলল–কেন রে সে তো সুখে আছে বলেই জানি।কেন তোকে কিছু বলেছে?বিশাখা বলল–সে আমার চেয়েও খারাপ আছে মা।আমার তবু স্বামীর স্বভাব চরিত্রে কোনো দোষ নেই।সে বাবা মার অনুগত হলেও আমাকে ভালোবাসে।তোমরা মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে ললিতার বিয়েটা ছেলের সেরকম কোনো খোঁজ খবর না নিয়ে পনেরো দিনের মাথায় দিয়ে দিয়েছিলে। অল্প বয়সের ভুলে শাস্তি যা দেওয়ার ওকে তো বাবা দিয়েছিল। তোমরা ওকে আরও দুবছর পর বিয়েটা দিতে পারতে। ও তো লেখাপড়ার মাথা ছিল।আর দুটো বছর লেখাপড়াটা করতে পারত।

পুটু বলল–বললিই যদি সবটা খুলে বল মা।আমার যে বুকটা কেমন ধড়ফড় করছে।ললিতার তড়িঘড়ি বিয়েটা না দিয়ে আমাদের ও কোনো উপায় ছিলনা।সে পাশের পাড়ার এক কায়েতের ছেলের সঙ্গে লুকিয়ে প্রেম করছিল।সে ছেলের প্রেমপত্তরখানা পড়বি তো পড় তোর বাপের হাতেই পড়েছিল।তখন তড়িঘড়ি বিয়ে না দিয়ে আমাদের উপায় ছিল?কিন্তু পনেরোদিনের মাথায় বিয়ে দিলেও বিয়েটা তো অবস্থাপন্ন পরিবারে শিউড়ি শহরেই দিয়েছিলাম। ছেলে বি এ পাশ করে কালেক্টারি অফিসে সরকারি চাকরি করে। বাবার বড় ব্যবসা।এসব খবর ঘটক দিলেও তোর বাবা নিজেও নিয়েছিল।বিশাখা বলল–ছেলেটার এক খুড়তুতো বিধবা বৌদির সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক আছে মা।সে নিজেদের বাড়িতেই রক্ষিতা পুষে রেখেছে।তার বাবা মা নিশ্চয়ই সব জানত বলেই তাড়াতাড়ি ছেলেকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করতে চেয়েছিল।বাবা ওদের আশে পাশের বাড়িতে খোঁজ খবর করলেই সব জানতে পারত। পুটু বলল–ওসব শত্রুদের রটনা। তাছাড়া ওসব মোহ পুরুষদের বিয়ের আগে একটু আধটু থাকলেও বিয়ের পর থাকে না মা।একটা দুটো ছেলেপুলে হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

রক্ষিতার কথা বলতেই পুটুর মনে পড়ে গেল অনেক কথা।এই রায় বাড়ির পুরুষরা স্ত্রৈন ও অতিমাত্রায় মাতৃভক্ত হলেও তাদের চরিত্রও ধোওয়া তুলসীপাতা ছিল না।এরা প্রায় মধ্যবয়সে রক্ষিতা পুষত।পটেশ্বরী বিয়ের বেশ কিছুদিন পর জেনেছিল তার শ্বশুরমশাইয়ের বর্ধমানে একজন গোপন রক্ষিতা আছে।বর্ধমানে এদের বেশ কিছু জমি ছিল।সেই জমি দেখাশোনার জন্য শ্বশুরমশাই এক ভাগীদারের বাড়ি উঠত।সেই ভাগীদারের বৌয়ের সঙ্গেই তার অবৈধ সম্পর্ক ছিল।তার দাপুটে শাশুড়িমা সব জেনেও না জানার ভান করত।বছরের দু দশদিন অনুগত স্বামীর এই শিকল ছিঁড়ে চরতে যাওয়াটা একরকম মেনে নিয়েছিল।

তার স্বামী যখন সোনার দোকান বেশ চালু হল তখন মাঝে মাঝে দু একদিনের জন্য কলকাতা যেত পাইকারি দরে পাকা সোনা চাঁদি,ব্রোঞ্জ তামা কিনতে। সেই সময় দোকানের বিশ্বস্ত দুই কারিগরকে সঙ্গে নিয়ে এক দুমাস অন্তর কলকাতা যেত। তখন একটা ক্ষীণ সন্দেহ যে তার হত না এমন নয়।তারও তখন প্রায় মধ্য বয়সই ছিল।কিন্তু মানুষটার ভালোবাসার সর্বগ্রাসী টানে সন্দেহটা উধাও হয়ে যেত।আজ বিশাখার কথা শুনে মনটা কেমন খচখচ করে উঠল।মৃত্যুর আগে তার শ্বশুরমশাই কলকাতায় একটা পুরোনো ফ্ল্যাট কিনে রেখে গিয়েছিলেন যদি পরিবারের কারোর বড় কোনো অসুখের চিকিৎসার জন্য ভবিষ্যতে দরকার লাগে বলে। তার স্বামী সেই ফ্ল্যটেই ওঠে।কিন্তু তার স্বামীর সঙ্গে তো দুজন কারিগর থাকে।তার মধ্যে একজন বামুন।সেই রাঁধা বাড়া করে।তার স্বামীর রক্ষিতা থাকলে এত বছরে সে কি জানতে পারত না?

ছোট জামাই কদাচিৎ দু একবার এখানে এসেছে।দেখে তো কখনও খারাপ মনে হয়নি।তার চারটে মেয়েই কম বেশি সুন্দরী। বড় মেয়ে আনন্দির গায়ের রঙ সামান্য চাপা। কিন্তু ছোট মেয়েটা এক কথায় রূপের ডালি।যেমন দুধে আলতা গায়ের রঙ তেমনই কাটা কাটা মুখ চোখ।মেয়েটার ব্যাপারে বিশাখা যা বলল সেটা বিশাখাকে মোহ বা শত্রুদের রটনা বললেও তার মনটা খচখচ করতে লাগলো। মাকে গালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে দেখে বিশাখা বলল–মা রাত দশটা বাজতে চলল।ওদের ফেরার সময় হয়ে এল।পুটু চমকে উঠে বলল–হ্যাঁরে আনন্দির ছেলে মেয়েরা কিছু খেয়েছে?–পাশের বাড়ি থেকে ওদের জন্য সেদ্ধভাত পাঠিয়েছিল মা।ওরা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।মা তুমি ঠাকুমার জন্য মন খারাপ কোরো না।তুমি তো যথেষ্ট সেবা যত্ন করেছিলে।পুটু মনে মনে ভাবল মানুষের মনের কথা যদি সবাই টের পেত।সে তো এতক্ষণ তার দুই মেয়ের কথা ভেবেই মাথায় হাত রেখে চোখ বন্ধ করে ভাবছিল।

ক্রমশ–

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *