#কবির_শেষ_সময়_কিভাবে_কেটেছিল **** মালবিকা পণ্ডা

#কবির_শেষ_সময়_কিভাবে_কেটেছিল

মালবিকা পণ্ডা

রবীন্দ্র কাব্যে মৃত্যু এসেছে বিভিন্নভাবে। জীবদ্দশায় মৃত্যুকে তিনি জয় করেছেন বারবার। কাব্য কবিতায় মৃত্যু বন্দনা করেছেন তিনি এভাবে- ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান’।
জীবনের শেষ নববর্ষের সময় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার সাধের শান্তিনিকেতনে। সেদিন তার কলমে রচিত হয়েছিল ‘সভ্যতার সংকট’ নামের অমূল্য লেখাটি। তারও কদিন পর ১৯৪১ সালেরই ১৩ মে লিখে রাখলেন, রোগশয্যায় শুয়েই ‘আমারই জন্মদিন মাঝে আমি হারা’।

রবীন্দ্রনাথ বেশ জোরের সঙ্গে বলতেন, আর সবার শরীর আর রবীন্দ্রনাথের শরীর এক নয়। কারণ অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। মহেন্দ্রনিন্দিত কান্তি, উন্নত দর্শন। বজ্রসেনের অলক্ষ্যে যেন নিজের সৌম্যমুর্তির কথাই উল্লেখ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ছয়ফুট দুই ইঞ্চি দীর্ঘ দেহ, চওড়া বুক, সবল পেশী, আজানুলম্বিত মহাভূজ, বৃষস্কন্ধ, সিংহগ্রীবা। বিধাতা উজাড় করে দিয়েছেন — স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য। এমন অলৌকিক মেধা, এমন বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, এমন রূপবান জীবন শিল্পী– কোটিতে গোটিক।

সঙ্গীত ও সাহিত্য চর্চার সঙ্গে চলেছে স্বাস্থ্যচর্চা। ছেলেবেলা থেকে তিঁনি লড়েছেন কুস্তি, সাঁতরে এপার ওপার করেছেন পদ্মা। টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়েছেন প্রবল আনন্দে। তাই এমন মজবুত শরীরে কোনো অসুখ সহজে এসে আক্রমণ করতে পারেনি। তিনি নিজেই বলতেন শরীরটা একগুঁয়ে রকমের ভালো ফলে দৈবাৎ কখনও জ্বর এলে বলা হত গা গরম। অতুলনীয় স্বাস্থ্য নিয়ে তার দীর্ঘজীবন লাভের একটিই কারণ ছিল। পরিমিত আহার এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাত্রা। এই প্রসঙ্গে প্রতিমাদেবী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন ক্লান্তি শব্দটা বাবামশাইয়ের অভিধানে ছিল না। তার ঘুম ছিল খুব কম, কখন যে তিনি ঘুমোতেন, কেউ জানতে পারতাম না। কিন্তু আর যেনো কথাটা বলতে পারছেন না। শরীরটা তেমন সায় দিচ্ছে না তা প্রায় বছরখানেক ধরে। কিন্তু কবির কদিন ধরেই অল্প অল্প জ্বর হচ্ছে।

প্রতিমাদেবী সেইসময় ছিলেন কালিম্পংয়ে। কবিও চললেন সেখানে। যাবার আগে অমিয় চক্রবর্তীকে লিখে গেলেন,কিছুদিন থেকে আমার শরীর ক্রমশই ভেঙে পড়ছে, দিনগুলো বহন করা যেন অসাধ্য বোধ হয়। তবু কাজ তো করতে হয়- তাতে এত অরুচিবোধ সে আর বলতে পারিনে। ভারতবর্ষে এমন জায়গা নেই যে পালিয়ে থাকা যায়। ভিতরের যন্ত্রগুলো কোথাও কোথাও বিকল হয়ে গেছে। বিধান রায় কালিম্পং-এ যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু মন বিশ্রামের জন্য এত ব্যাকুল হয়েছে যে তার নিষেধ মানা সম্ভব হল না। চল্লুম আজ কালিম্পং। নির্মলকুমারী মহলানবিশকে অবশ্য বলেছিলেন, কালিম্পং যাওয়া তার উচিত হবে না। বরং গিরিডি যাওয়ার দিকেই মন ছিল। কিন্তু শেষমেশ গেলেন সেই কালিম্পংয়েই।

এবার কালিম্পং যাত্রাই যেনো কবির জন্য কাল হলো। ২৭ সেপ্টেম্বর কবি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। প্রতিমাদেবী তড়িঘড়ি কলকাতায় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে খবর পাঠালেন। সেদিন আবার মৈত্রেয়ী দেবী কবির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। কালিম্পংয়ে সাহেব ডাক্তার খুব করে ধরেছিলেন অপারেশনের জন্য। কিন্তু কবির অপারেশনের আপত্তির কথা ভেবেই, প্রতিমাদেবী রাজি হলেন না। কবিকে ফিরিয়ে আনা হলো জোড়াসাঁকোর বাড়িতে।

দোতালার পাথরের ঘরটায় রাখা হয়েছে তাকে। গায়ে জ্বর। কীরকম একটা ঘুম ঘুম আচ্ছন্ন অবস্থা। ভালো করে কথা বলতে পারছেন না, কিন্তু মন সজাগ। ওই অবস্থাতেই একদিন দুপুরে রানী মহলানবিশকে ডেকে বললেন, সামনের ওই আলমারিটা খোলো তো। ওই শিশিটা নিয়ে এসো। বায়োকেমিকে কবির খুব বিশ্বাস ছিল। কবির এই বায়োকেমিক প্রীতির কথা নির্মলকুমারী ভালোই জানেন। ওষুধের বাক্সটা আনতে আনতে তিনি ভাবলেন, এবার নিশ্চয়ই নিজেই নিজের চিকিৎসা করবেন। ওষুধ এনে গোটা ছয় বড়ি কবির মুখে দিতে যাবেন, অমনি কবি মৃদু স্বরে বললেন, আমি না নিজে খাও। হাত যে একেবারে পুড়ে যাচ্ছে। আমার গায়ে হাত বুলোচ্ছ তাই টের পাচ্ছি যে, তোমারও আমারই অবস্থা, তুমি আবার আমার সেবা করছো।

১৮ নভেম্বর কবি ফিরলেন শান্তিনিকেতনে। কখনই কারও সেবা নিতে চাইতেন না। কিন্তু এবারে তিনি যেনো অসহায়। বাধ্য হয়েই নিজেকে ছেড়ে দিয়েছেন সেবক-সেবিকাদের হাতে। এমনকি ডিকটেশন দিয়ে লেখানোর কাজও তিনি কখনও করেননি। এবার তাই করতে হচ্ছে। কখনও বা চেয়ারে একটু বসেন। কখনও বিছানায় শুয়ে পড়েন। সময় কী তবে ফুরিয়ে আসছে? জানলার ধারে আরামকেদারায় বসে প্রতিমাদেবীর বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকেন। দেখেন সৃষ্টির বিচিত্র এই লীলা। জীবন যেমন আছে, তেমনই মৃত্যুও আছে। তা তিনি সহজভাবে স্বীকারও করে নিয়েছেন।

তবু জীবন যেমন সত্য, মৃত্যুও ততোটাই সত্য। খুব কষ্ট হয় তা জানি, তবু এ কথা অস্বীকার করলে চলবে না যে মৃত্যু না থাকলে জীবনের কোনো মূল্যই থাকে না, যেমন বিরহ না থাকলে মিলনের কোনো মানে নেই। তবু তরী যে কেন এমন হঠাৎ ডুবে যেতে চায়! কবির শরীর যেনো নিজের মনের সজীবতার সঙ্গে তাল রাখতে পারে না।

কিন্তু কবির শরীর যেনো আর চলে না। ১লা জুলাই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, রথী ঠাকুরের থেকে একটা চিঠি পেলেন। তিনি লিখেছেন, ইন্দুবাবুরা বুধবার এসেছিলেন। ওদের তিনজনেরই অর্থ্যাৎ রামবাবু, জ্যোতিবাবু ও ইন্দুবাবুর মতো যে, অপারেশন করা উচিত। ইন্দুবাবু ভার নিয়েছেন যে ললিতবাবু শিলং থেকে ফিরলেই তাকে এখানে নিয়ে আসবেন-পরীক্ষা করবার জন্য। তারপর অপারেশনের দিন স্থির হবে। ইতিমধ্যে জ্বরটা কমবার জন্য অটোভ্যাকসিন দেওয়া হবে। ইউরিন এ গতবার কলি পাওয়া গেছে। রামবাবু আবার কাল আসছেন সম্ভবত ভ্যাকসিন নিয়ে আসবেন। বাবার শরীর খুবই খারাপ হয়ে গেছে। জ্বর রোজই ১০০.৪ ডিগ্রি উঠছে। এখন সবসময় শুয়ে থাকতে হয় এত দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তাই বিশেষ রকম চিন্তিত হয়ে আছি।

কবির অপারেশনে একদমই ইচ্ছে নেই। কেবল বলেন,আর কদিনই বা বাকি আছে? এই কটা দিন দিক না আমাকে যেমন আছি তেমন করে থাকতে। কোনোদিন তো আমাকে যেতেই হবে। কিন্তু আমি কবি। আমার ইচ্ছে কবির মতনই যেতে-সহজে এই পৃথিবী থেকে ঝরে পড়তে চাই, শুকনো পাতার মতো। যাবার আগে আমাকে নিয়ে এই টানাছেঁড়া কেন? তাই কবির ইচ্ছেতেই এলেন কবিরাজ বিমলানন্দ তর্কতীর্থ মশাই। তাকে কবি বললেন, দেখো হে তোমরা আমার কিছু করতে পার কিনা। ছেলেবেলা থেকে আমার শরীরে কোন অস্ত্রাঘাত হয়নি। শেষকালে কি যাবার সময় আমাকে ছেঁড়াখোঁড়া করে দেবে? কবিরাজ আশ্বাস দিয়ে বললেন, কবির নাড়ির গতি খুবই ভালো। যদিও এ রোগ পুরোপুরি সারে না, তবু শরীরের গ্লানি অনেকখানি কমে আসে। কবি বললেন, তাহলেই হল। এই বয়সে তো আর আমি লাফালাফি করতে চাচ্ছি না। … হাতের আঙুল টাঙুলগুলো আড়ষ্ট হয়ে গেছে, লিখতে পারি না আজকাল। এটুকু পেলেও তো অনেকখানি ।

সেইমতো শুরু হলো চিকিৎসা। শরীরের এই হালেও রীতিমতো চালিয়ে যাচ্ছেন রসিকতা। একদিন ইন্দিরা দেবীকে সামনে পেয়ে নালিশ জানিয়ে বললেন, তুই দেখ আমাকে এরা আজকাল কি খেতে দিচ্ছে। এ কি কখনো খাওয়া যায়? না কেউ কাউকে খেতে দেয়? … কবিরাজমশাই বলেছেন এসব খেলেই নাকি আমি আর কদিন পরে লাফালাফি করে বেড়াতে পারবো। কিন্তু তুই সত্যি করে বল এসব কি মানুষে খেতে পারে? কেবলই চালকুমড়ো খাবো, কেবলই চালকুমড়ো খাবো? আর কি ভালো জিনিস কিচ্ছু নেই? তুই তো দেখছিস, এঁরা আমাকে কী খেতে দেন। তারপর আবার বলেন আহা আর একটু খান, আপনি কিছু খাচ্ছেন না ইত্যাদি ইত্যাদি। আরে, ভালো জিনিস একটু কিছু দাও, তারপরে দেখো খাই কিনা।কবির নালিশ করার ধরন দেখে সবাই হেসে উঠলেন। তাকে ঘিরে আনন্দের হাট যেমনি ছিলো তেমনই আছে। জীবনের এই চক্রটিকে বেশ ভালভাবে অনুধাবন করতে পারছিলেন। সেই পদ্মাচরের দিন আজ আর নেই। আজ আশেপাশে ঘোরাঘুরি অনেক নতুন মানুষের। এরকমটাই তো হওয়ার কথা- কবিরাজিতেও কাজ হচ্ছে না। ধীরে ধীরে সবাই অপারেশনের দিকেই ঝুঁকলেন। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলেন কবি
নিজে।

তথ্য সূত্র দ্যা ওয়াল

চলবে….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *