উপন্যাসিকা। সূর্যশিশির। পর্ব-১০ ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

উপন্যাসিকা।
সূর্যশিশির।
পর্ব-১০
ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
“ওলো সই,ওলো সই, আমার ইচ্ছে করে তোদের মতো মনের কথা কই!”
দুপুরে মধুরা বাড়ির কর্তাদের খাওয়ার সময় গিয়ে দাঁড়ায়। এটাই নিয়ম।বিরাট ডাইনিং টেবিলে বড়ো বড়ো কাঁসার থালা বাটি গ্লাস। কর্তারা তিন ভাই, তাঁদের পুত্রসন্তানেরা এবং শতমন্যু খেতে বসেছে।এখন বেলা দুটো।বৃন্দাদেরও বসতে বলা হয়। ওরা বলে যে,ওরা মধুরা আর বাড়ির অন্য মেয়েদের সঙ্গেই বসতে চায়। পরে সকলের খেয়ে উঠতে উঠতে বেলা সাড়ে তিনটে বেজে যায়। খাওয়া দাওয়া করে মধুরার ঘরে এসে বসে সব। এবার কুহেলী বলে -‘তোর শ্বশুরবাড়ির সবাই খুব ভালো, কিন্তু বেশ গম্ভীর!’- মধুরা হঠাৎ কেঁদে ফেলে। -‘না রে, এই বাড়ির সবাই খুব ভালো। আমাকে সবাই খুব ভালোবাসেন। কিন্তু আমিই তাঁদের মর্যাদা রাখতে পারিনি।’- এবার হাল ধরে শ্রী। -‘কি ব্যাপার মধু? কি ভাবে তুই ওনাদের মর্যাদা হানি করলি?’- -‘বা রে! বাড়ির বৌ ছোট বাচ্চাকে রেখে রোজ বেড়িয়ে যাবে, এমনকি দুদিন উধাও হয়ে যাবে, অমর্যাদা নয় সেটা?’- -‘কি ব্যাপার বলতো? কোথায় উধাও হয়েছিলি?’- কুহেলী বলে। শ্রী বলে -‘বাদ দে।আমরা বরং আমাদের ছোটবেলায় ফিরে যাই। মনে আছে আমাদের নিবেদিতা স্কুলের কথা। এই ঠোঁট ফুলুনি মধু প্রায়ই মায়ের ওপর অভিমান করে কাঁদতো।’- মধুরা বলে -‘ধানাইপানাই করিস না শ্রী। তুই সাইকোলজিস্ট না সায়ক্রেয়াটিস্ট? আমার পেটের কথা টেনে বের করবি তুই? তোর পেটের কথা তো আমিই বুঝে গেছি। হি হি!’- হাসতে হাসতেই চোখের জল মোছে মধুরা।-‘তবে এবার আমি সত্যিই বলবো রে শ্রী। আমার কিছু কথা শেয়ার না করলে আমি বাঁচব না।’-
-‘বল্ রে মধু! একটু হাল্কা হ’- বৃন্দা বলে। মধুরা বলে -‘শ্রী বলছিলো না, আমি আমার মায়ের ওপর অভিমান করতাম! সত্যিই তাই। মা কেন আমাকে টপকে বাবাকে দখল করতে চাইতো? বাবা তো আমার বাবা! জানিস, রাতে আমি খাটে বাবা মায়ের মাঝখানে শুতাম। বাবার বুকে মুখ গুঁজে। বাবা আমার মাথার চুলে বিলি কেটে দিতো। মাও আদর করতো। তবু আমি মাকে ঠেলে সরিয়ে বাবার দিকে ঘেঁষে শুতাম। অথচ জানিস, মাঝরাতে আমাকে মা পাশে সরিয়ে ঠিক বাবাকে জড়িয়ে শুয়ে পড়তো। বাবাও মাকে খুব আদর করতো। আমার ভীষণ হিংসে হতো। আমি আবার মায়ের ওপর দিয়ে টপকে মাঝখানে চলে যেতাম, বাবাকে আঁকড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলতাম,’আমার বাবার পাশে শুধু আমিই শোবো।’- মা চুপ করে আমার জায়গায় শুয়ে থাকতো।’- শ্রীময়ী বলে -‘এই রকম কি রোজ হতো?’- মধুরা বলে -‘প্রায়ই। একদিন ঘুম ভেঙে দেখি বাবা মা কেউ বিছানায় নেই। মেঝে থেকে একটা গোঙানির মতো আওয়াজ আসছে। ভাবলাম ওরা পড়ে গেছে। ভীষণ ভয় করতে লাগলো। ভূত নয় তো! কেঁদে উঠলাম বাবা বাবা করে। আর সেই প্রথমবার বাবার ধমক শুনলাম -‘কি হচ্ছে খুকু? ঘুমোও!’- সেই প্রথমবার মা আমার গায়ে হাত তুললো। কারণ আমি প্রশ্ন করেছিলাম -‘মা, তুমি ব্লাউজ খুলেছো কেন?’- শ্রীময়ী বললো -‘তার মানে তোর প্রথম প্রেম তোর বাবা!’- -‘শ্রী, আমার বাবার মতো পুরুষ আমি দেখিনি। আমার বাবার মতো সুদর্শন, আমার বাবার মতো মার্জিত, আমার বাবার মতো শিক্ষিত পুরুষ আমি দেখিনি। তাই আমি কোনো চ্যাংড়া ছোঁড়ার প্রেমের জালে ফাঁসিনি।আমি তো বলতাম বিয়ে করতে হলে বাবার মতোই বর চাই। -‘তাই কি দেবর্ষি স্যার!!’- কুহেলী বিস্মিত হয়। শ্রীময়ী বলে -‘আমি কিন্তু আন্দাজ করেছিলাম। বয়স্ক পুরুষ, প্রাজ্ঞ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের মধ্যেই মধুরা তার বাবাকে খুঁজে পায়। খুঁজে পায় ভালোবাসার মানুষকে। এমনকি যৌনতাও। ঠিক বলছি মধু?’- মধুরা হু হু করে কাঁদতে থাকে। -‘একজ্যাক্টলি, অল্পবয়সী পুরুষ নারীর শরীর বোঝে, উদ্দাম যৌনতা বোঝে, নারীর মন বোঝে না। সম্মান বোঝে না। শতমন্যু সত্যিই খুব ভালো, কিন্তু ম্যাচিওর না।’- শ্রীময়ী জড়িয়ে ধরে রোরুদ্যমানা মধুরাকে। বন্ধুদের বলে -‘এরকম খুব কম দেখা যায়। প্রাজ্ঞ, বিদগ্ধ, স্নেহশীল বয়স্ক মানুষের প্রতি এই আন্তরিক আকর্ষণকে বলে স্যাপিও সেক্সুয়াল অ্যাক্টিভিটি। মধুরা আসলেই স্যাপিও সেক্সুয়ালিস।’- শ্রীময়ী মনে মনে ঠিক করে শতমন্যুকে কিছু টিপস দেবে, যাতে সে মধুরার গার্জেন হয়ে উঠতে পারে। বর নয়, স্বামী নয়, অভিভাবক; যে বুকে করে আগলে রাখবে মধুরাকে।।