উপন্যাসিকা। সূর্যশিশির। পর্ব-৮। ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

উপন্যাসিকা।
সূর্যশিশির।
পর্ব-৮।
ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

দেবর্ষি বর্দ্ধমানে ফিরে খবর পায় বিশাখা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কাজের সূত্রে বিভিন্ন কলেজ ইউনিভার্সিটিতে ট্রান্সফার হলেও অন্যদের মতো স্ত্রীকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় থাকার সুযোগ দেবর্ষির নেই। নার্ভের জটিল অসুখে বিশাখা আক্রান্ত হয়েছে অন্তত কুড়ি বছর আগে। নিঃসন্তান বিশাখা একমাত্র স্বামীকে আঁকড়ে বাঁচতে চায়।প্রতি সপ্তাহে তাই দেবর্ষি শনি ও রবিবার কোলকাতায় আসে। বিশাখার ঘরে ঢোকে দেবর্ষি। এককালের স্নিগ্ধ সুন্দরী প্রেমিকা, নৃত্যশিল্পী বিশাখা তার হিল্লোলিত তনুলতায় নৃত্যরসে দর্শকচিত্ত সিক্ত করে তুলতো। দেবর্ষি মুগ্ধতায় ডুবে গিয়েছিল। সোজাসুজি বিয়ের প্রস্তাব। সব নাচের অনুষ্ঠানে দেবর্ষি নিয়ে যেতো বিশাখাকে। একদিন নাচতে নাচতেই স্টেজে পড়ে গেলো বিশাখা। তারপর‌ই প্যারালাইসিস। ভেলোরে ছুটলো দেবর্ষি। সেই থেকে পনেরো বছর টানা ভেলোর যাওয়া, বছরে দুবার। অনারোগ্য এম.এস.রোগে আক্রান্ত সে!মেরুদণ্ডে ইঞ্জেকশন,কড়া কড়া ওষুধ।বছর পাঁচেক আগে থেকেই মানসিক জোর হারিয়ে ফেলছিলো বিশাখা। বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পাচ্ছিলো না। তার নাচের জগৎ হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। এরপর একদিন তার বাঁদিক নিথর হয়ে গেল। তারপর পুরো শরীর। হতাশ দেবর্ষি বাড়িতেই যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করলো।রাতদিনের আয়া নার্স নিযুক্ত করলো। জলের মতো টাকা খরচ করতে লাগলো। আর নিজেকে ডুবিয়ে দিলো আরো বেশী পড়াশোনা ও লেখার কাজে। স্থানীয় কলেজে প্রফেসর হিসেবে যোগ দিলো। তখনই মধুরা আসে জীবনে, যদিও প্রচ্ছন্ন ভাবে।
বিশাখার দিকে তাকায় দেবর্ষি। অস্থিসার শরীরটা ঝরে পড়া শুকনো পাতার মতো লেপ্টে আছে বিছানায়। অক্ষম হাতটা তুলে স্বামীকে ছোঁয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা অসহায় নারীর! দেবর্ষি খাটের দিকে এগিয়ে যায়। আয়া সসম্ভ্রমে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। দেবর্ষি শুকিয়ে যাওয়া পাতাটার পাতলা ঠোঁটে ঠোঁট রাখে। পাহাড়ি ছাগলের মতো নির্বোধ অথচ বড়ো বড়ো পল্লবে ঘেরা দুটো সুন্দর চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে বিশাখা। অনেক প্রশ্ন জমে থাকে তার চোখে।অনেক আকুতি! মাত্র‌ই দুদিন আগে দেবর্ষিকে পরিপূর্ণ নারীশরীরের আস্বাদ দিয়েছে মধুরা। বিশাখাকে আঁকড়ে সেই স্মৃতিটাকেই যেন খুঁড়ে তুলতে চায় দেবর্ষি। বিশাখার পাঁজর ঢাকা চামড়ায় নখ বসে যায় দেবর্ষির। বিশাখার দুই চোখের জল তার কান ছুঁয়ে বালিশে গড়িয়ে পড়ে। তার অক্ষম, দুপাশে এলিয়ে থাকা হাত দুটো তিরতির করে কাঁপতে থাকে আলিঙ্গনের আকাঙ্ক্ষায়। এর বেশী গ্রহণ করার সাধ্য তার নেই। অকাল বৃদ্ধার হৃদয়ভরা ভালোবাসা,কিন্তু শরীরে প্রেম জাগে না,কামনা জাগে না। শুধু অনভিপ্রেত উত্তেজনায় খানিকটা বর্জ্য পদার্থ বেরিয়ে আসে। দেবর্ষি আয়াকে ডাকে না। নিজেই বিশাখার হাল্কা দেহটা তুলে নিয়ে যায় ওয়াশরুমে। শাওয়ারের নিচে চেয়ার পেতে বসায় বিশাখাকে। পরম যত্নে পরিষ্কার করে তার শরীরের ক্লেদ। বাদুড়ের মতো চর্মাবৃত শরীরটা তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে কোলে করে ঘরে নিয়ে আসে। হাল্কা পোষাক পড়িয়ে দেয়। আর একভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকে বিশাখা। দেবর্ষি আয়াকে ডেকে গরম দুধ আনতে বলে। আজ অতিরিক্ত পরিশ্রম হয়ে গেছে বিশাখার, অপ্রত্যাশিত পরিশ্রম! দুধ খেতে খেতেই ঘুমে ঢলে পড়ে বিশাখা। গভীর ঘুম! শান্তির ঘুম!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *