“সাহিত্য ও সম্প্রীতি” রাকা ভট্টাচার্য্য

“সাহিত্য ও সম্প্রীতি”
রাকা ভট্টাচার্য্য

সাহিত্য বরাবরই মানুষে মানুষে সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। সাহিত্যের যথার্থ ধারক ও বাহক অর্থাৎ লেখক কবিরা সবসময়েই চেষ্টা করেছেন সাহিত্যের প্রচার হবে সম্প্রীতিমূলক। মানুষে মানুষে ধর্মে বর্ণে ক্ষমতায় বিভেদ তৈরী করা কখনই সাহিত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য নয়। বরং সকল বাঁধন আগল ভেঙে মানুষে মানুষে ঐক্যের বন্ধন ই হলো সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার মূল উদ্দেশ্য।
বর্তমান মুখবই নির্ভর সাহিত্য চর্চা দ্রুত লেখক ও পাঠকের মধ্যে এক যোগাযোগ তৈরীর বলিষ্ঠ সেতু। লেখক তার লেখা সম্পর্কিত মন্তব্য তৎক্ষণাৎ জানতে পারে, এ এক বড় মজার উৎসাহমূলক বিষয়। বিষয়টি পাঠকের কতটা মনোগ্রাহী হলো বা আদৌ হল কিনা তা পাঠকের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা যায়।
সাধারণ প্রেম বিরহের কাহিনী বা কবিতা, ভৌতিক কাহিনী ,কল্প কাহিনী এগুলো মন্তব্যের দাঁড়ি পাল্লায় ওজন করলে লেখক ও পাঠকের বা লেখকের সাথে লেখকের (যেহেতু লেখক ই পাঠক) সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের গভীরতা মেপে নেওয়া যায়। এইভাবে মুখবই সাহিত্য দেশে দেশে ও দেশ বিদেশের মানুষে মানুষে এক সুন্দর সম্প্রীতি গড়ে তুলছে।
যা আমাদের ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারতের জন্য এক গৌরবমণ্ডিত বিষয় বা দিক।
কিন্তু সমস্যা তখনই জেগে উঠছে যখন কোনো সামাজিক রাজনৈতিক ঘেঁষা অস্থির বিষয়ের প্রতিবাদে কোনো লেখক বা কবির কলম গর্জে উঠছে। বিষয় যাই ঘটুক তার দায় যখন কিছুটা হলেও সরকারের উপর বর্তায় তখনই লেখকের সমর্থনে ও অসমর্থনে দুটি দল বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। অসমর্থন থাকতেই পারে। লেখকের সমর্থিত বিষয়ে অন্য কোনো লেখক কবি বা পাঠকের অসমর্থন থাকতেই পারে আর লেখকের লেখার বিরুদ্ধে তিনি বিপরীত মন্তব্য পেশ করতেই পারেন কিন্তু লেখকের লেখার বিরোধিতা করা মানে এই নয় যে লেখকের বিরুদ্ধ হয়ে ওঠা বা চরম শত্রু হয়ে ওঠা।
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা নির্ভর লেখা প্রমাণ করল লেখক কবির লেখার বিরোধীতা করতে গিয়ে কিছু মানুষ কীভাবে ধর্ম ও রঙের প্রাধান্য দিতে গিয়ে নিজেদের মানবিক বোধটুকু হারিয়ে ফেলছেন।কিছু মানুষ এখন এতটাই অসহিষ্ণু , অধৈর্য্যশীল ও ক্ষমতান্ধ যে তারা রঙের বাইরে বেরিয়ে এসে তাদের লেখার প্রচার রাখতে অক্ষম, শুধু তাই না তাঁরা ক্ষমতার কাছে গ্রেপ্তারের দাবী রাখে , লেখকের বিরুদ্ধে তাঁরা এতটাই প্রতিহিংসা পরায়ণ যে মিথ্যা দোষারোপ দিয়ে চরম হেনস্থাও করে কেউবা নিজের ধর্মকে মহান ও ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল লেখায় বিদ্রুপের হাসি ছুঁড়ে দিয়ে হেয় করেন, অথচ এরাই প্রেম ভালোবাসার লেখায় তারিফের পর তারিফ করে সেই একই লেখক কী কবির মন্তব্যের বাক্স ফুল চন্দনে ভরিয়ে দিয়েছেন।
এরকমই সম্প্রতি ও অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুইটি মন তোলপাড় করা ঘটনা নির্ভর লেখার কথা তুলে ধরা যায়—
১। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার মেয়েটির নৃশংস মৃত্যু যখন গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিল তখন স্বাভাবিকভাবেই বহু মানবিক কলমে ঘটনার কথা উঠে এসেছে। যেটুকু চোখে দেখা গেছে বা সংবাদমাধ্যমে জানা গেছে তাই উঠে এসেছে বহু সংবেদনশীল কলমে কিন্তু সেই সময় কিছু বিশেষ রঙিন লেখক পাঠক এইসব মানবিক লেখকদের বিরুদ্ধে গিয়ে তাঁদের মন্তব্য বাক্স নানান কু মন্তব্যে ভরিয়ে দেয় ও চরম অপদস্থ করে। লেখকের বিরুদ্ধে লেখকের কিছু বলার থাকলে তা তার নিজস্ব মুখবই দেওয়ালেই যুক্তিপূর্ণ ভাবে ও ভাষায় ব্যক্ত করাই যায়। কোনো লেখক কবিকে কি মানায় চরম রঙিন বা দলবাজ?
২। আর একটি অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনা যা যেকোনো সংবেদনশীল লেখক বা কবিকে প্রবল নাড়া দিয়ে কলম ধরতে বাধ্য করে, কাশ্মীরের পহেলগাঁও উপত্যকায় জঙ্গী বা আতঙ্কবাদীদের গুলিতে হিন্দু পর্যটকদের আকস্মিক নিহত হওয়ার ঘটনা। ঘটনা যখন কলমে উঠে আসে বিরোধীতার রঙিন পাথর ছোঁড়া হয় মন্তব্য বাক্সে, কেউবা সদ্য বিবাহিতা মেয়েটির স্বামী হারানো দৃশ্যের ছবি থাকা সত্ত্বেও বিদ্রুপের হাসি হেসে যায়। শুধুমাত্র রঙের কারণে ধর্মের কারণে মানুষ কীভাবে এত অমানবিক হয়?
তাহলে কি লেখক বা কবি সময়ের ঘটে যাওয়ার কথা নিরপেক্ষ ভাবে বলবেন না? নাকি বললে তাঁকে মানবিকতার আসন থেকে জোর করে নামিয়ে পাক্ষিকতার আসনে বসিয়ে দেওয়া হবে? তবে কি সত্যের কলম, সামাজিক ঘটনার কলম থেমে থাকবে মিথ্যা সম্প্রীতি বজায় রাখার নাটকে?
না, সাহিত্যিকের কলম শুধু প্রেম ভালোবাসার স্বপ্ন স্রোতে গা ভাসিয়ে চলে মিথ্যা সম্প্রীতি রক্ষার ভান করবে না। সাহিত্যিকের কলম রঙহীন দলহীন ধর্মহীন নিরপেক্ষ সামাজিক ঘটনার কথাও বলবে, বলবে মানুষের কথা। লেখক বা পাঠককেও একই মানসিকতায় পরিপুষ্ট হয়ে তা পাঠ করতে হবে, তবেই সাহিত্য সম্প্রীতি রক্ষার এক চিরন্তন মাধুর্যময় মাধ্যম হয়ে উঠবে। ৩০,০৪,২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *