#ধারাবাহিক #রায় বাড়ির অন্দরমহল পর্ব–৪ ছবি ব্যানার্জী

#ধারাবাহিক
#রায় বাড়ির অন্দরমহল
পর্ব–৪
ছবি ব্যানার্জী
পরদিন ধনঞ্জয় কবিরাজ এসে অনেকক্ষণ নাড়ি দেখলেন।ব্রহ্মময়ী বলল–এবার কি মরণের নিদেন হাঁকবি নাকি রে হতচ্ছাড়া?ধনঞ্জয় বলল–অতখানি আস্পর্ধা আমার নেই খুড়ি মা।সে নিদান স্বয়ং বিধাতা পুরুষের হাতে।আপনি বরং যা খেতে মন চায় খান খুড়িমা।খাওয়ার বিধিনিষেধ আমি তুলে নিলাম।
বাইরে বেরিয়ে এসে রাধাকান্তকে বলল–ভাই তুমি যাকে খবর দেওয়ার দিয়ে দাও।দিন দশ পনেরোর বেশি খুড়িমা আর টিকবে না।নাড়ির গতি কমতে শুরু করেছে।পুটু কথাটা শুনে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে লাগলো।এক গলা ঘোমটা দিয়ে বলল–আপনি এটা কি শোনালেন?মার তো তেমন শরীর খারাপ এখনও হয়নি।আপনি নতুন ওষুধ করে দিন।ধনঞ্জয় বলল–বৌমা আমি কিছুই বলছি না।খুড়িমার নাড়ি বলছে।তোমরা বরং পাশ করা ডাক্তার এনে একবার দেখাতে পারো।
রাধাকান্ত বলল–দাদা পাশ করা ডাক্তার তো আগেই জবাব দিয়েছিলেন। তুমিই সারে তিনবছরের ওপর আমার মার নতুন পরমায়ু দিয়েছিলে।শুধু দেখো আমার মাকে যেন মৃত্যু যন্ত্রণা পেয়ে দগ্ধে দগ্ধে মরতে হয় না।
খবরটা ঝি চাকর মারফত ছড়িয়ে পড়তে দেরি হল না।এমনিতেই পাঁচ সাতজন প্রতিবেশী নিয়মিত বেম্ভ ঠাকরুনকে দেখতে আসত।খবরটা শুনে দলে দলে সবাই একবার করে বেম্ভ ঠাকরুনকে দেখতে আসতে লাগল।আর আসবে নাই বা কেন।মানুষটার মুখ যতো প্রখর ছিল মনটা ততটাই দরজা ছিল।গ্রামের এমন হেন গরীব মানুষ নেই যে বেম্ভ ঠাকরুনের দয়া দাক্ষিন্য পায় নি।কেউ মেয়ের বিয়ের জন্য এসেছে কেউ মা বাপের চিকিৎসার জন্য শ্রাদ্ধের জন্য এসেছে। কেউ অভাবে এসেছে।ব্রেম্ভ ঠাকরুন কাউকেই খালি হাতে ফেরান নি।এছাড়াও তার নিজে হাতে রাঁধা পাঁচমেশালি চচ্চড়ি আর কুচো মাছের আনাচ দেওয়া টক তো পাড়ায় বিখ্যাত ছিল।এই দুটো পদই শেষপর্যন্ত বাড়ির মেয়ে বৌদের জন্য পড়ে থাকত।দু রকমের মোটা মাছ, ডালনা, শুক্ত ভাজাভুজি বাড়ির পুরুষরা যাচাই খাওয়ার পর যেটুকু অবশিষ্ট থাকত সেটাতে আস্ত মাছ ভাজা ডালনা আর ভাজাভুজি বিশেষ অবশিষ্ট থাকত না।ঝুড়ির ঝড়তি পড়তি আনাচ দিয়ে এক জল ছাড়া এক কড়াই বিখ্যাত চচ্চড়ি আর মাছওয়ালির কাছ থেকে ভাতের চালের বিনিময়ে কেজি খানেক কুচো পাঁচমেশালি মাছ সর্ষে লংকা বাঁটা দিয়ে বেশি পরিমান রান্না করতেন বেহ্ম ঠাকরুন নিজে।এই খাবার পুরুষরা খেত না। এই রান্না পাড়ার মেয়ে বৌরা হামেশাই চাইতে আসত।এক একদিন দিতে দিতেই সেটাও সামান্য অবশিষ্ট থাকত।এটা সাত আট মাস আগে পর্যন্ত বেম্ভ ঠাকরুন নিজে এই দুটো পদ রান্না করতেন।সেই টক আর চচ্চড়ি একবার যে খেয়েছে তার স্বাদ এখনও মনে রেখেছে।
কিন্তু এই লোক ভাঙা দেখে শাশুড়িমা একদিন বলল–হ্যাঁগো বৌমা বাড়িতে দু বেলা এত লোক আসছে কেন?আমার তিন নাতনিই বা খুঁটি গেড়ে বসে আছে কেন শুনি?তাদের ঘর সংসার নেই?নাকি গাঁ শুদ্ধ লোক থেকে তোমরা সবাই আমার মরণ তাকিয়ে বসে আছো?
পুটু কি বলবে বুঝতে না পেরে বলল–মা ওরা কটা দিন বেড়াতে এসেছে আর আপনাকে একবার দেখতেও এসেছে।ব্রহ্মময়ী ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল–কেন আমি কি চিড়িয়াখানার বাঘ না ভাল্লুক?তারপরই নরম গলায় বলল–কদিন ধরে তোমার শ্বশুর মশাইকে আমি স্বপ্ন দেখছি বৌমা।আর বড় অখাদ্য কুখাদ্য খেতে ইচ্ছে করছে।পুটু ব্যাকুল হয়ে বলল–মা আপনার কি খেতে ইচ্ছে করছে?সে মুখে বলাও পাপ মা।আমার হাঁসের ডিমের ঝোল মাছের রগরগে করে লাল ঝোল, ,গুগলির কষা তরকারি আর জিলিপি খেতে ইচ্ছে করছে।
পুটু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–মা আমি এক্ষুনি আপনার নাতিকে জিলিপি আনতে বলছি।কিন্তু আর যা চাইছেন সেটা আপনি আদেশ করলেন সেগুলো লুকিয়ে আপনাকে খাওয়াতে পারি। পাপ হলে আমার হবে–ছিঃ ছিঃ তাই কি বলতে পারি?নাকি লুকিয়ে খেতে পারি?তুমি যেন একথা শত্রুতা করে আর কাউকে বলতে যেওনা। বৌমা তোমার সঙ্গে আমার যতই আকচা আকচি থাক তবু এতকাল তোমাকে আমি বুক দিয়ে আগলে রেখেছি। হয়তো এটা আমার মরণকালের ভীমরতি।
তুমি বরং এক কাজ করো।এই চাবিটা নিয়ে সিন্দুকটা খুলে আমার গয়নার বাক্সখানা এনে দাও। আমি জানি আমি মরলে সবকিছুই তুমিই পাবে।তবু আমি হাতে তুলে সবাইকে কিছু দিয়ে যাব।আর একটা কথা কটা দিন একটু সকাল সকাল রান্না আর খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে নিও।আমার দিন ঘনিয়ে এসেছে।একটিবার যদি ঠাকুর মন্দিরে গিয়ে গোপীনাথ রাধারানীকে দর্শন করে প্রণাম করতে পারতাম।আর নাত বৌকে দেখে যেতে পারতাম।পুটুর বুকটা ধক করে উঠল।কেন যে শেষ সময়টাই স্বামীর কাছে কথাগুলো বলতে গেল।সে মনে প্রাণে শাশুড়িমার জন্য অন্তত আরও তিন চার মাস ঠাকুরের কাছে আয়ু প্রার্থনা করল।
ক্রমশ–