হিউম্যানিজম, #মৌসুমি

হিউম্যানিজম,
#মৌসুমি
মণিদিপা ঘড়িতে দেখলো সাড়ে সাতটা বেজে গেছে।। তাড়াতাড়ি স্টেশনের দিকে হাঁটা দিলো।। শেয়ালদাহ তখন ভীড়ে ভীষন ঠেসাঠেসি।। যেভাবেই হোক, নটার মধ্যে স্কুলে পৌঁছতেই হবে।।লেডিসে উঠে বসলো।। উল্টোদিকের কিছু মহিলা বসেছিলেন।।রোজই এই সময়ে যায় তারা।।কোন একটা কারখানায় কাজ করে হয়তো।। ট্রেন স্টেশন ছেড়ে বের হলো,।সাধারণত ফেসবুক দেখে সময় কাটাতে কিন্তু গত দুদিন ফেসবুক খুলতে ইচ্ছে করছে না।। শুধু কান্না আর নানানরকম বিরক্তিকর পোস্ট।। হঠাৎ মনিদিপার কানে এলো ” এই নাজমা এখন থেকে তাড়াতাড়ি আসবি।
রোজ রোজ তোর জায়গা রাখতে পারবো না।”কথাশুনে পাশের মহিলাটি বলল,”আর বলোনা মাসি! মিনসে, মুখপোড়া জামাল কাল মাল খাবে বলে আমার থেকে টাকা কেড়ে নিয়েছিল।। আমার নামও নাজমা দিয়েছি মুখপোড়াটাকে বেদম পেটানি”।। মনিদিপা ওদের কথা শুনছিল আর মনে মনে ভাবল,এত ঘরের কথা বলছে অথচ কাশ্মীর নিয়ে একটাও কথা নেই এই মহিলাদের মধ্যে।।তারা হয়তো আদৌ জানেই না কি হয়েছে।।
স্কুলে যাওয়ার পর,প্রথম ক্লাস শেষ হবে হবে হেলাল স্যারের ফোন “মনিদিপা, তুমি কি স্কুলে,শোনো একটা অনুরোধ করবো,রাখবে? হ্যাঁ হেলাল দা বলুন।।আসলে আমার স্ত্রী অসুস্থ, তাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি, তোমার তো টিফিনের পরের ক্লাসটা অফ, তুমি একটু আজকে আমার এইটের ক্লাসটা নিয়ে নেবে।। মনিদিপা ফোনের এদিক থেকে আশ্বাস দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো।। মনে মনে ভাবলো, হেলাল দা রোজের মতোই তো স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছিল। তবে কি স্ত্রীর অসুস্থতায় কাশ্মীরের ঘটনা ভুলেই গেছেন?
স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ভাবলো কিছু বাজার করেই ঢুকবে।।বাজার তো তেমন নেই।।আর সিদ্ধার্থ রোজ রোজ বাজার যাওয়ার সময় পায়না।। সব্জি বাজারে ঢুকে কিছু কাঁচা বাজার করে পাঁচশো টাকার নোট দিতেই বিক্রেতা বললেন “ম্যাডাম,খুচরো দিন।। আমার কাছে খুচরো নেই”।। মনিদিপা ব্যাগে হাত দিয়ে দেখলো তার কাছেও খুচরো নেই । সব্জি বিক্রেতা “আচ্ছা দেখছি” বলে পাশের বিক্রেতা কে জিজ্ঞেস করল,”এই বিনয় পাঁচশোর খুচরো দে না বাপ”।।বিনয় মাথা নেড়ে বলল “আব্দুলের কাছে আছে।। ওকে বলো”সব্জি বিক্রেতা চেঁচিয়ে বলল “এই হতাভাগা আব্দুল,ফোন নিয়ে কি করছিস আমাকে খুচরো করে দে দেখি “।। আবদুল হেসে বলল” আরে কাকা,কাশ্মীরে কি হয়েছে জানো তো “।।
তা আর জানবো না,তবে ওই করলে তো আমাদের মুখে ভাত উঠবে না,মেলা না বকে টাকাটা দেয়ে ম্যাডাম দাঁড়িয়ে আছে।।” আব্দুলের থেকে খুচরো নিয়ে সবজি বিক্রেতা মনিদিপার হাতে ধরিয়ে দিলো।। রাস্তায় যেতে যেতে ভাবছিল, চারিদিকে যা হচ্ছে সেকুলার সেকুলার করে রুটি রুজির কারণে হারুকাকা,বিনয় অথবা আব্দুলের তাতে কিছুই আসে যায় না।
বাড়িতে ঢুকেই কানে এলো নিউজ চ্যানেলের বকবকানি।।তার মানে সিদ্ধার্থ বাড়ি চলে এসেছে।।তার আর কি কাজ।। বাড়ি ফিরেই টিভিতে নিউজ চ্যানেল বদলে যাবে আর রিপোর্টারগুলোর কচকচানি শুনে যাবে।। কিন্তু মনিদিপার তো ছুটি নেই।। বকুলদি কে ছেড়ে দিতে হবে।। আজকাল বকুল দি বেশি রাত করে বাড়ি ফিরতে ভয় পাচ্ছে।। যেদিন থেকে মুর্শিদাবাদ থেকে ফিরেছে বকুলদির মনে কি একটা আতঙ্ক কাজ করছে।।তখন সন্ধ্যা আট টাও বাজেনি।। মনিদিপা রান্নাঘরে ঢুকে বলল “বকুলদি তুমি চা টা করে চলে যাও।।রাত করতে হবে না।”
সাধারণ মানুষের রোজের জীবন ফেসবুক থেকে অনেক আলাদা।। দেশের এক কোণায় ঘটে যাওয়া বিভৎস ঘটনার কথা এই দেশের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর মধ্যে কেউ জানে কেউ জানে না।। এখানে যা লিখলো তা নিছকই মনিদিপার রোজের দেখা একটা পরিচিত চিত্র।।তবে এই লেখা ফেসবুকে লিখলে কিছু মানুষ যে তেড়ে আসবে সেকু মেকু বলে তা নিশ্চিত।।তবু দেশের সহস্র খেটে খাওয়া গরীব মানুষগুলোর জীবনে ভালো খারাপ কোনটারই প্রভাব পরেনা সেটা নিশ্চিত।।জানি না আগামীর দিনে হবে তবে যুদ্ধ এবং নানান বিশৃঙ্খলার কারণে এই অতিসাধারণ মানুষগুলো যে চরম দুর্ভোগে পরবে সেটুকু অন্তত নিশ্চিত।।
মাঝেমাঝে মণিদিপার মনে হয় সেকু মেকু ছেড়ে যদি হিউম্যানিজম নামেও কেউ ডাকতো! তিরস্কারই সই।।