এই বৈশাখেই হোক বাঙালি জাতির নবজাগরণ কলমে – উজ্জ্বল কুমার দত্ত।

এই বৈশাখেই হোক বাঙালি জাতির নবজাগরণ

কলমে – উজ্জ্বল কুমার দত্ত।
“”””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””
নববর্ষ তথা বাংলা বছরের প্রথম মাস বৈশাখের তাৎপর্য বাঙালি জীবনে অত্যন্ত গভীর। ১- লা বৈশাখ এবং ২৫ শে বৈশাখ একই সূত্রে গাঁথা। দুটি দিবসেরই গুরুত্ব অপরিসীম। ১- লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন আর পঁচিশে বৈশাখ এমন একজন বাঙালির জন্মদিন যিনি না এলে বাঙালি জাতির অনেক কিছুই অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যার আগমন বাঙালি জাতির সুনামকেই শুধু সুপ্রতিষ্ঠিত করেনি, বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংগীতকে যেমন করেছে সুসমৃদ্ধ, তেমনি শিক্ষা, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম-দর্শন প্রকৃতির ক্ষেত্রেও অপরিমীয় দিক নির্দেশনা রেখে গেছেন। বিশ্বের দরবারে বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রথম ধাপটি তিনি বলিষ্ঠভাবে নির্মাণ করে দিয়েছেন “গীতাঞ্জলি” রচনা করে নোবেল পদক অর্জনের মাধ্যমে ১৯১৩ সালে। বাঙালি যে একটি সুপ্রাচীন জাতি। তাঁর রয়েছে হাজার বছরের আলোকিত ইতিহাস, বিপুল বৈচিত্র্যময় আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির ধারা এটা বিশ্বব্যাপী বিদ্যসমাজের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে এশিয়া মহাদেশে তার প্রথম নোবেল পুরস্কার অর্জনের ফলে। অমিতবল সুপ্ত একটি জাতির ঘুম ভাঙিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এটা সহজেই বলা যায়। আমরা অনেকেই জানি না যে, ভারতসভ্যতাকে বিশ্ব দরবারে ব্যাপকভাবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পেয়েছেন যেসব বাঙালি সেই কতিপয় বিরল বাঙালির অন্যতম হচ্ছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর দুজন হলেন তার পূর্বসূরী আধুনিক ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা, সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় (১৭৭৪-১৮৩৩) এবং সমসাময়িক ধর্মীয় সংস্কারক, আধ্যাত্মিক পন্ডিত স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২)।

জাতি হিসেবে বিলুপ্ত আত্মমর্যাদার উদ্ধার, স্বাধিকারের স্ফুরণ ঘটাতে কলকাতাস্থ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি যে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল তার সুযোগ্য নেতৃত্বদানে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা এককথায় অপরিসীম। কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলার স্বল্পায়ু নবজাগরণ বাংলার অঞ্চলব্যাপী তেমন ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে না পারলেও বাঙালির আত্মআবিস্কারের সূচনা-দ্বারের উন্মোচন করেছিলেন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে কলকাতাতেই বিংশ শতকের প্রারম্ভে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য তার যে অমিতবল জাতীয়তাবাদী রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি সাহিত্য ও সংগীত রচনার মধ্যে তা যে কতখানি সুদূরপ্রসারী হয়েছিল তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ জাতীয়তাবোধ জাগ্রতকারী গানগুলি রচনার মাধ্যমে। অপরিসীম আত্মিক শক্তি জুগিয়েছিল তার সেইসব গানগুলি। যেমন “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”… যার পরতে-পরতে বাঙালি জাতিসত্তা ও স্বদেশিকতার অতি অপরিসীম দরদ উথলে উঠেছিল। এই যে একটি গানের মধ্য দিয়ে কোটি-কোটি মানুষের মনে মাতৃভূমির প্রতি দরদ সৃষ্টি করা, আবার সেই দরদকে বিদ্রোহী বাহুবলের রূপান্তরিত করা আদৌ সহজ কাজ নয়, যা রবীন্দ্রনাথ সক্ষম করেছিলেন। সেই কালজয়ী গানই আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠী সেই বাংলাদেশের শাসনভার দখল করেছে। তারা এই জাতীয় সংগীত কে বদলে দিতে চায়। তারা তাদের ইতিহাসকে মনে রাখতে চাই না। ইতিহাস বিমুখ এক বর্বর জাতি সে দেশের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করে দিতে চায়। ইতিমধ্যে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তারা ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর উপর আক্রমণ চালিয়েছে। বৈশাখী শোভাযাত্রায় দেখা গেছে শুধুই হাসিনা বিরোধী স্লোগান। সেখানে আমজনতার প্রবেশের অনুমতি নেই। শোভাযাত্রা আখেরে পরিণত হয় দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী এক মিছিলে। ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পায় এই শোভাযাত্রা। কিন্তু সে গৌরব আজ লুণ্ঠিত। বাংলাদেশের ইতিহাস আজ চুরি হয়ে গেছে। দুষ্কৃতীরা মসনদ দখল করেছে। আস্তে-আস্তে রবীন্দ্র-নজরুল সে দেশে অপাংকেও হয়ে যাবে বোধহয়। মৌলবাদী গোষ্ঠী উর্দুকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে।

সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও বাঙালি জাতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘাটতিও বিদ্যমান। যা রবীন্দ্রনাথ দেশ বিদেশে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন এবং পরিপূর্ণ একটি সংস্কৃতি গঠনে সেসব ঘটনাগুলো পূরণের চেষ্টায় নিবিষ্ট হয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি হল বাংলা নববর্ষকে জাতীয়ভাবে মর্যাদাদান। বাঙালির চিরকালীন আধ্যাত্মিক সাংস্কৃতি চর্চার সূচনা হোক ১- লা বৈশাখ দিয়ে, তাই বাঙালি জাতির পরিচয়ের প্রথম ধাপ হিসেবে রচনা করে গেছেন সর্বমনজয়ী বর্ষবরণীয় সংগীত–“এসো হে বৈশাখ এসো এসো…”। এই গানটির মধ্যে একাধিক দিকনির্দেশনা বিদ্যমান। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে একটি শাশ্বত বাণী অত্যন্ত সুস্পষ্ট সেটি হল– পরিশুদ্ধ হয়ে ওঠা। সারা বছরের আবর্জনা দূর করে দেবার জন্য বৈশাখের রুদ্রচেতনাকে আহবান করেছেন কবি। এই রুদ্রচেতনা এসে বাঙালিকে তার জীবন-সমাজ ,তার মননকে পরিশুদ্ধ করুক। তার বাণীর প্রাবল্যে আমরা যেন প্রতিবছর হয়ে উঠতে পারি বিশুদ্ধ ও সুন্দর। সর্বপ্রকার মানসিক জ্বরাব্যাধি, হিংসা-বিদ্বেষ, বিভাজন দূর করে দিতে এই রুদ্রচেতনার বিকল্প আর কিছু নেই। অবশ্য ভুলে গেলে চলবে না যে, কবির প্রত্যাশিত এই রুদ্রচেতনা আদৌ মানবিক সৌন্দর্য হন্তারক নয়– মানুষের অবচেতন মনে এসে চেপে বসা অসুস্থ প্রবণতা, অপকৃতি ও অবগুণগুলোর ধ্বংসকারী এই শক্তি। শুভ শক্তি ও সুস্থতা অর্জনের প্রতিকী ব্যঞ্জনায় উৎকৃষ্ট ও সমৃদ্ধ এমন আবাহনী সংগীত আর কোন জাতির জন্য কোন কবি বা দার্শনিক রচনা করে গেছেন কিনা জানিনা, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ করে গেছেন। কাজেই এই প্রাপ্তির মূল্য আমাদের কাছে যেমন অপরিসীম, তেমনি এর মর্যাদা রক্ষা করাও জাতির জন্য অবশ্য কর্তব্য। সেইসঙ্গে এটাও একটা ব্যতিক্রম ঘটনা যে নববর্ষের প্রথম মাসেই তার জন্ম। নিজের জন্মমাস হিসেবে বৈশাখের প্রতি তার স্বাভাবিক একটা পক্ষপাতিত্বমূলক ভালোবাসা ও দুর্বলতা নিশ্চয়ই ছিল। তাই এই মাসটাকে বাঙালি জীবনে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ১-লা বৈশাখকে আলাদা মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন বললে অত্যুক্তি হয় না। সে জন্যই আমরা পেয়েছি নববর্ষের এমন অসাধারণ উদ্বোধনী সংগীত।

কিন্তু আজকে বাঙালি চলতি হাওয়ার পন্থী হয়ে নববর্ষের এই আবাহনীর সংগীতের মর্ম কতখানি বুঝতে পারছে সেটাই প্রশ্ন। যেভাবে চটকদার রঙেচঙে স্লোগানসর্বস্ব ১- লা বৈশাখ বা নববর্ষ উদযাপিত হচ্ছে তাতে করে বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কতখানি অনুসৃত হচ্ছে ভেবে না দেখলে নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে যে রবীন্দ্র সংগীতগুলি নির্মাণ হচ্ছে তা কতটা রাবীন্দ্রিক তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। সুর বিকৃতি ও তির্যক কন্ঠ এই সংগীতে কখনোই কাম্য নয়। অত্যধিক আধুনিক ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করে রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন অনুচিতই নয় ; এটি একটি অপরাধের শ্রেণীতে পড়ে। রবীন্দ্রসংগীত মূলত ভাবপ্রধান ও অর্থ সুদূরপ্রসারী। বিশ্বভারতীকে এ সম্পর্কে কঠোর হতে হবে। নববর্ষ আবহমান বাংলার ঐতিহ্যানুসারে উদযাপিত হোক– রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকীও ভাবগম্ভীর পরিবেশে আনন্দালোকে উত্তীর্ণ হোক– দুটো ক্ষেত্রেই যেন সস্তা বাণিজ্য, সস্তা জনপ্রিয়তা, রুচিহীনতা, উলঙ্গ আধুনিকতা এবং প্রাণসংহারী নাশকতার মতো ঘটনা না ঘটে– তার জন্য আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে। আমরা তাঁর অর্জিত নোবেল পদকটিকেও রক্ষা করতে পারিনি। এটা বাঙালি জাতির লজ্জা।

কবিগুরু চেয়েছিলেন একটি পূর্ণাঙ্গ বাঙালি সংস্কৃতি। সুশোভন,বিশুদ্ধ, রুচিশীল নববর্ষ উদযাপন তারই একটি সংযোজন। বাঙালি জাতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ একটি জাতীয় শুদ্ধসর্বজীবনাচার তার রচনা ও কর্মকাণ্ডে রেখে গেছেন। সত্যিকার অর্থেই যদি আমরা পরিশুদ্ধতা চাই, পরিপূর্ণতা চাই, পরিমুক্তি চাই তাহলে তাকে উপলব্ধি করতে হবে আগে– গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে তার গান গেয়ে নববর্ষ উদযাপন কিংবা তাকে স্মরণ করার মধ্যে কেবল ধৃষ্টতারই পরিচয় ফুটে উঠবে। সেই রুচিহীনতা ও ধৃষ্টতা আমাদের কাম্য নয়। শিক্ষক নিয়োগ সম্পর্কিত দুর্নীতি হোক বা মেডিকেল কলেজে প্রতিভাময়ী ডাক্তারের খুন। এগুলি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিমুখ পরিবেশ সৃষ্টি হওয়াতেই মর্মান্তিক এই ঘটনাগুলি ঘটে চলেছে। এই অস্থির, অসহিষ্ণু, সহিংস পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় ধৈর্য ধারণ ও শুদ্ধতাচর্চা। আর এ দুটোই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা বিষয়ক রচনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত; যা আমাদেরকে অবশ্যই পাঠ করতে হবে। আমাদের নিজেকে চিনে নেবার, পরিশুদ্ধ করার সব পথ ও মত রবীন্দ্রনাথেই নিহিত আছে। শুধু সঠিক অনুসন্ধানের দৃষ্টিভঙ্গিটা এখন অর্জন করা প্রয়োজন। আর এটাই হোক আমাদের সকলের বাংলা ১৪৩২ সালের প্রধান লক্ষ্য। গুরুদেব আমাদের সঙ্গে আছেন, থাকবেন ও পথ দেখাবেন।

(মতামত ব্যক্তিগত)

কলমে – উজ্জ্বল কুমার দত্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *