#ধারাবাহিক #রায় বাড়ির অন্দরমহল ছবি ব্যানার্জী। পর্ব–২

#ধারাবাহিক
#রায় বাড়ির অন্দরমহল
ছবি ব্যানার্জী।
পর্ব–২
ধনঞ্জয় ঘোষাল সব শুনে বলল–অ্যালাপাথি ওষুধ ইঞ্জেকশন দিয়ে দিয়ে বারোআনা কাজ তো সেরেই ফেলেছিস ভাই।এই রোগের চিকিৎসা একমাত্র কবিরাজি চিকিৎসা।গাঁয়ের যোগী ভিখ পায়না বলে আমাকে হ্যালা ছেদ্দা করার ফল তো হাতেনাতে পেলি।রাধাকান্ত বলল–দাদা মা যে পাশকরা ডাক্তার দেখানোর জন্য বড্ড বায়না করছিল।ছেলে হয়ে মায়ের ইচ্ছা অমান্য করি কি করে বলোতো তো?–এই তো তোদের দোষ।রোগীর বেমক্কা বায়নাতে কান দিতে আছে?একি দোকানের সাজানো মিষ্টি?বায়না করলেই কিনে দিতে হবে?আসলে পাশ করা ডাক্তার না দেখালে তোদের দেখনধারী ট্যাটাস যে দেখানো হবে না।শুধু তোকে বলেই বা কি করব।এটা পয়সাওয়ালা সব মানুষই করে।পাশকরা ডাক্তার হাসপাতালে জবাব দেওয়া সব রোগীরাই শেষ চিকিৎসার জন্য শেষ পর্যন্ত আমার দরজায় আসতে হয়। যাকগে ডাকলি যখন চল একবার দেখি কতটা সচল করতে পারি।
ধনঞ্জয় এসে সব দেখেশুনে বলল–খুড়িমা আপনি নিজে উঠে বসতে পারেন?ব্রহ্মময়ী বলল–দিন কতক আগে বেশ পারছিলাম বাছা।এখন খুব কষ্ট করে ওই বসাটুকুই পারি।ধনঞ্জয় বলল– শুনুন খুড়িমা আপনাকে দু বেলা কবিরাজি তেল মালিশ করতে হবে।তেলটায় একটু কটু গন্ধ থাকবে।তেলটা গায়ে পায়ে কোমরে বসে গেলে গরম জলে গামছা নিঙরিয়ে মুছে দিলে গন্ধটা থাকবেনা। আর তার সঙ্গে খল নুড়িতে মেশানো ওষুধ যেটা চেটে খেতে হবে সেটা তিন ঘন্টা অন্তর খাওয়াতে হবে দিনে চারবার।আর রাতে খাওয়ার পর একটা কবিরাজি ট্যাবলেট।আর খুড়িমার এখন থেকে খাটে নরম বিছানায় শোওয়া চলবে না।তাকে নীচু চৌকিতে শুধু একটা মোটা শক্ত কাঁথা পেতে ঘুমাতে হবে।
নিদান শুনে বেম্ভ ঠাকরুন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলল–দুর হ মুখপোড়া। চিরকাল আমি খাটের নরম গদি তোষকে ঘুমিয়েছি।এখন এই বয়সে আমি খটখটে চৌকিতে ঘুমাবো?ধনঞ্জয় বলল–খুড়ি মা আপনি এখনই তো বাতের ব্যথায় কোঁকাচ্ছেন। একবার খাট থেকে দাঁড়িয়ে দেখুন তো পারছেন কিনা। ব্রহ্মময়ী বলল–পারলে আর তোকে ডাকব কেন রে হতচ্ছাড়া।–তবু একবার চেষ্টা করে দেখুন। ব্রহ্মময়ী কোনোরকমে উঠে বসে একবার উঁচু খাট থেকে নেমে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে বিফল হলেন।তার গোটা শরীরটা ব্যথায় ঝনঝন করে উঠল।
ধনঞ্জয় বলল–খুড়িমা এরপর আপনার নিজে নিজে পেচ্ছাব বাহ্যি করার ক্ষমতাও থাকবে না।আমার সব নিদান না মানলে আপনি আর কখনও চলা ফেরা তো দুরের কথা, নিজে বসার ক্ষমতাটুকুও থাকবে না।এবার আপনিই ভেবে দেখুন কি করবেন।
ব্রহ্মময়ী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল–আমার গা গতরের ব্যথা কমাতে পারবি?ধনঞ্জয় হেসে বলল–আমার চিকিৎসা মানলে আশা করছি আপনি আবার দাপটে রাজ্যপাট সামলাতে পারবেন।–এর অন্যথা হলে তোর চিকিচ্ছে আমি করব না।—বেশ তাই হবে। হ্যাঁ আর একটা কথা খুড়িমাকে অন্তত দু ঘন্টা রোদ খাওয়াতে হবে।ব্রহ্মময়ী বলল– বলছিস কিরে হতচ্ছাড়া!এই গরমের রোদে রোদ খাওয়াতে হবে?কেন রে আমি আচার না বড়ি যে রোদ খাওয়াতে হবে?ধনঞ্জয় বলল– খুড়িমা শরীর পুরনো হলে আচার বাড়ির মতো রোদ খাওয়ালে চাঙ্গা থাকে।আপনার মাথাটা ছায়ায় থাকবে।সেই সময় আপনি রসুন তেল মালিশ করতে পারেন।কথাটা শুনে ব্রহ্মময়ী খুশি হল। এই তেল মালিশটা সে খুব উপভোগ করে।কিছু সময়ের জন্য ব্যথার উপশম হয়।এবার থেকে তিনবার বৌকে তেল মালিশ করতে হবে।দ্যাখ কেমন জব্দ হবি এবার। খুব মরণ তাকিয়ে বসেছিলি। ধনঞ্জয় বলল–তাহলে আজ আমি আসছি।আবার সাতদিন পর এসে দেখে যাব।রাধাকান্ত তুই ঘন্টাখানেক পর একবার আমার বাড়ি এসে ওষুধ পত্র নিয়ে আসবি।আমি ততক্ষণ ওষুধগুলো তৈরি করে রাখি।
এদিকে পটেশ্বরী ওরফে পুটু সুন্দরী মনে মনে নীরবে গর্জাচ্ছিল। নব্বই বছরে ও শাশুড়িমা নাকি সুস্থ হয়ে বহাল তবিয়তে রাজত্ব করবেন।কেন বেশ তো শয্যে নিয়েছিলেন।আবার কবরেজকে ডাকার দরকার কি ছিল?তার স্বামী তার বশংবদ হলেও মুখ ফুটে শাশুড়িমার নামে একটা কথা বলার তার ক্ষমতা ছিল না।এবার থেকে দুবার দুর্গন্ধযুক্ত কবিরাজি তেল মালিশ করা একবার রসুন তেল মালিশ করা থেকে ওষুধ খাওয়ানোর কাজটা তাকেই করতে হবে। শাশুড়িমার চান করানো থেকে হাগা মুত পরিস্কার করার জন্য মাস খানেক আগে এই গ্রামের দাই রাইমণিকে মোটা টাকা মাইনে দিয়ে রাখা হয়েছে। নেহাত কোনো সজ্জাতের মেয়ে গু মুত করবে না বলে শাশুড়িমা বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছেন।কিন্তু শুধু ওই কাজটুকু ছাড়া তার আর কোনো সেবা যত্ন তিনি নেবেন না।চান করার পর কাচা কাপড়খানাও তাকেই পরাতে হয়।আর পায়ে তেল মালিশ কোনো কালেই কারোর হাতে নেন নি।ওটা একমাত্র তাকেই করে আসতে হয়েছে।
পুটুর বড় শখ ছিল শাশুড়িমার মৃত্যুর পর ছেলের বিয়ে দিয়ে নিজে শাশুড়ি সেজে এই সংসারের সর্বময়ী কর্ত্রী হওয়ার। যদিও তার ছেলের বিয়ের বয়স তখনও হয়নি। বুড়ি আর কতকাল বাঁচবে কে জানে।নব্বই বছরের মাকে নিয়ে তার স্বামীর এই আদিখ্যেতা দেখলে তার হাড় মাস জ্বলে যেত।
আবার বলে কিনা মা একটু হেঁটে চলে বেড়াতে পারলেই ছেলের বিয়ে দেবেন।
বর্তমানে পুটু সুন্দরীর এগারোটা সন্তানের মধ্যে চারটে কন্যাসন্তান আর একটা মাত্র পুত্র সন্তান শশীকান্ত জীবিত।ছটা সন্তানের মধ্যে কেউ পেটে কেউ ভূমিষ্ঠ হয়ে মারা গেছে। একমাত্র বড় মেয়ে আনন্দময়ী স্বামী সন্তান চার ছেলে মেয়ে নিয়ে নিয়ে ঘর সংসার করছে।মেজ মেয়ে রাধারানী জন্ম থেকেই খুঁতো।তার দুই পায়ে ছটা করে আঙুল ।ঠিক বুড়ো আঙুলের পাশে ছোট বড় দুটো আঙুল। এটা নিয়ে তার হাঁটা চলার অসুবিধা ছিল না।কিন্তু বিয়ের সময় একথা পাত্রপক্ষের কাছে গোপন করা হয়েছিল।তার পদ্মকলির মতো হাতের পাতা,টকটকে গায়ের রঙ আর একঢাল চুল দেখে পাত্রপক্ষ চুল গায়ের রঙ আর পা লুটানো কাপড় পরে হাঁটা পরীক্ষা করেই সন্তুষ্ট হয়েছিল। পায়ের পাতা আর আলাদাভাবে পরীক্ষার কথা মাথায় আসেনি।প্রচুর উপঢৌকন দিয়ে রাধারানীর বিয়ে দিলেও শুধুমাত্র পায়ের খুঁত আর সেটা গোপন করার অপরাধে ফুলশয্যার পরদিনই তাকে চাকর দিয়ে বাপের বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রাধারানীর শ্বশুরমশাই অবশ্য তাদের দেওয়া গয়না দান ফার্ণিচার সব ফেরত পাঠিয়েছিল।
সেজ মেয়ে বিশাখা আর ছোট মেয়ে ললিতার এখনও সন্তান হয়নি।তারা শ্বশুর বাড়িতে ঘর সংসার করছিল। পুটু সুন্দরী মেজ মেয়ের এই পরিণামকে ভাগ্যের হাত বলে মেনে নিলেও এই নিয়ে মনের মধ্যে একটা চিরস্থায়ী ক্ষত আছে। দুবেলা কুল দেবতা গোপীনাথ ও রাধারানীকে প্রণাম করার সময় প্রার্থনা করে সেজ আর ছোট মেয়ের ঘরসংসারটা যেন ঠিক থাকে।সেজ মেয়ের তিন বছরের ওপর বিয়ে হয়ে গেল এখনও সন্তানের মা হতে পারেনি।কালে কস্মিনে সে বাপের বাড়ি এলে তার বিষণ্ণ মুখটা দেখে আজও পুটু সুন্দরীর বুকটা অজানা আশংকায় কেমন কেঁপে ওঠে।
ক্রমশ–