আত্মজা *** অধ্যায়-১৫ সুদেষ্ণা সিনহা

আত্মজা
————–
ধারাবাহিক উপন্যাস
অধ্যায়-১৫
সুদেষ্ণা সিনহা
ভোর ভোর ঘুম ভেঙে গেল স্বাধীনতার। বারো সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষ।আজই স্কুলে জয়েন করতে হবে।মেয়েটা ঘুমোচ্ছিল তার বুকের ওমে।পাশ থেকে উঠে পড়তেই মেয়েটা নড়ে উঠল একবার।আলতো হাতে পিঠে চাপড় দিতেই মেয়ে আবার চোখ বুঁজে ঘুমিয়ে পড়ল। ওর গোলাপি ঠোঁটদুটোর ফাঁকে জিভটা কেঁপে উঠল দু’বার।
অনেক ভাবনা-চিন্তা করে স্বাধীনতার স্কুলের কাছের পুরোনো বাসাতেই ফিরে আসা হয়েছে।
বাড়িওলি বৌদি একটা বৌকে দেখে দিয়েছে। ভদ্র বাড়ির বৌ। কোনদিন কাজ করতে বেরোয়নি।স্বামী হাতুড়ে ডাক্তারি করত।উপড়ি পয়সা ছিল।কিন্তু রাজকীয় চালচলনে,খাওয়াদাওয়ায়,মদের আসরে সব টাকা উড়িয়ে স্বামী মারা গেছে। দুটি নাবালক ছেলে নিয়ে বৌটি এখন অথান্তরে পড়েছে।তার দুই ছেলে স্কুলে পড়ে। সারাদিন সে থাকতে পারবে।কিন্তু রাত্রে থাকতে পারবে না।স্কুল থেকে ফিরে এসে ওকে ছেড়ে দিতে হবে।
স্বাধীনতা রাজী হয়েছে। মেয়ে সামলানোর জন্য তার বিশ্বাসী লোক চায়। যদিও বাড়িওলি বৌদি খুব ভাল। তাদের অনুপস্থিতিতে সবটাই নজরে রাখবে,এই টুকু আশা করা যায়। আপাতত বৌটা তার মেয়ে সামলাবে,রান্নাও করবে।
পুরোনো মাসিকেও ডেকেছিল স্বাধীনতা।মাসি আগের মত ঘর মোছা,কাপড় কাচা,বাসন মাজা করবে।
অলোক এখন এখানেই থাকবে। বাসস্ট্যান্ড থেকেই ত্রিমোহিনী যাবার সরাসরি বাস পাবে সে।বাস রাস্তার ধারেই তার স্কুল।কাজেই খুব একটা অসুবিধা হবে না তার।
একবার ঘরে ঢুকে অলোককে শুয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে তাকাল স্বাধীনতা।
—শুয়ে আছ যে। শরীর খারাপ নাকি? আজ স্কুল যাবে না?
—নাহ,আড়িমুড়ি ভাঙল অলোক,ভাল্লাগছে না।আজ যাব না।
— ও,তাহলে তো ভালোই হল।মেয়েটাকে ছেড়ে যাব প্রথমদিন।মনটাও খচ্ খচ্ করছিল।
—-সব রেখে যাও।আমি দেখে নেব।
—চা খাবে না?
—না তুমি খেয়েদেয়ে স্কুলে যাও।আমি একটু শুয়ে নিই।
মাতৃত্বকালীন ছুটির যাবতীয় হাবিজাবি কাগজপত্র ব্যাগে ভরে নেয় স্বাধীনতা।আজ বড়দির কাছে জমা দিতে হবে।
ব্যাগে টিফিন ভরে স্বাধীনতা বেরিয়ে যায়।কাঁথায় তার মেয়েকে জড়িয়ে বৌটি মিস্টি হাসে।
—-ভয় কোরো না দিদি।আমি দুই ছেলের মা।আমি তোমার মেয়েকে মানুষ করে দেব।
—-এখন থেকে তুমিই ওর মা।তোমার হাতেই ছেড়ে গেলাম।দেখো।
দরজা লাগিয়ে ঘরে ঢুকতেই অলোক বৌটিকে ডাকে।
—-একটু শোন ।
—- আমাকে ডাকছেন?
—–হ্যাঁ, কি নাম তোমার?
—– সুপ্রিয়া,দাদা…
—–ওও…আমাকে এক কাপ চা করে দাও।
—-আচ্ছা দিচ্ছি।
বাচ্চাটিকে বিছানার এক পাশে শুইয়ে দেয় সুপ্রিয়া।কোল থেকে নামাতে গিয়ে সুপ্রিয়ার আঁচল কিছুটা সরে যায়।অলোক একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।সুপ্রিয়া দ্রুত আঁচল সরিয়ে নিয়ে রান্নাঘরে চা করতে যায়।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে বসে অলোক। এই অঞ্চলটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম।লাল মোড়ামে ঢাকা রাস্তায় চলছে কিছু মানুষ,সকলেই পেটের তাগিদে যেন ছুটছে।
এখন শীতের শেষ। এই সময়টায় বাতাসের রুক্ষতায় চামড়ায় বেশ টান ধরে।একেক সময় ঝটকা বাতাসে গাছের শুকনো পাতা ঝরে যায়।পলাশ আর কৃষ্ণচূড়া লালে লাল।বসন্ত এসে গেল।
চোখ ফেরাতেই অলোক দেখে সুপ্রিয়া দাঁড়িয়ে আছে দরজা ঘেঁষে।
—কিছু বলবে?
—হ্যাঁ দাদা।আপনি কিছু খাবেন না?
—-কি খাব?
—-মুড়ি দেব?
—-আচ্ছা দাও।তুমি খেয়েছো?
—-আপনাকে দিই।তারপর খাব।
সুপ্রিয়ার প্রতি একটা টান অনুভব করে অলোক। মানুষ কত অসহায়!মেয়েটার একটা সংসার ছিল।সেই সংসারের কর্ত্রী ছিল সে।তার কথামত সেই সংসার চলত।অথচ ভাগ্য বিড়ম্বনায় তাকেই আজ অন্যের দরজায় আসতে হয়েছে।
রুমমেট প্রদীপ আজ কাছে থাকলে বলত,শালা কোন্ মেয়েটাকে দেখলে তোর মায়া হয় না,বল দেখি?কলির নাগর!
সুপ্রিয়া শরীরে একটা আলগা শ্রী আছে।চোখদুটো বড় কাছে টানে।অফুরন্ত যৌবনে মেয়েটা স্বামীহারা।
বাচ্চাটাকে তেল মাখাচ্ছে সুপ্রিয়া। হাঁটু অবধি কাপড় গুটিয়ে উন্মুক্ত পায়ের উপর শুইয়ে দিয়েছে মেয়েকে। মসৃণ,ফর্সা ,উন্মুক্ত পা দুটো দেখে মাথা ঘুরে যায় অলোকের।এইরকম পায়ে চুম্বন দিয়ে যদি সে বলতে পারত,দেহি পদপল্লব মুদারম…..।
খাওয়াদাওয়ার পর বারান্দায় মাদুর পেতে শুয়েছে সুপ্রিয়া।বাচ্চাকে দুধ খাইয়ে দিয়েছে।বাচ্চা এখন খাটে ঘুমাচ্ছে তার পাশে।
অলোক শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে।কিছুতেই ঘুম আসছে না।জানলা বেয়ে চোখ চলে যায় বারান্দায়।
এখন একটা অদ্ভুত টানাপোড়েন চলছে মনের মধ্যে।স্বাধীনতার সঙ্গে সুপ্রিয়ার তুলনা করছে সে।স্বাধীনতার কমনীয়তা বড় কম!আবেগ আছে!একবারও কি মনে হয়েছে তার স্বামী কি চায়!উপোসী শরীরের খিদে মেটাবার একটুও ইচ্ছে হয় না? অলোক দেখেছে,কাছে টানলেই একটা না একটা অজুহাত—না গো আজ না,বড্ড ঘুম পাচ্ছে।
আর তা না হলে—আচ্ছা এখন নয়,মেয়ে উঠে পড়বে।
বড় খারাপ লাগে অলোকের। এইভাবে প্রত্যাখ্যান? না হয় নারী শরীরের প্রতি তার একটু ছুকছুকানি বেশী,তাই বলে এতো নিস্পৃহতা?
সাত পাঁচ ভেবে ভেবে চোখটা লেগে এসেছিল বোধহয়।দরজায় কলিং বেল বাজছে।স্বাধীনতা এসেছে।দরজা খুলে দিল সুপ্রিয়া।
স্কুলের জামাকাপড় ছেড়ে স্বাধীনতা এ ঘরে আসতেই সুপ্রিয়ার চা জলখাবার রেডি।বাহ্ মেয়েটা বেশ তৎপর।ভালো লাগল স্বাধীনতার।
—ওমা,এই ঘরে নিয়ে এলে?
— দাদা একা আছেন।দু’জনে মিলে খাও।পুচকিটা তো ঘুমোচ্ছে।
—-কিছু বিরক্ত করেনি তো মেয়ে?
—-না না ও ভীষণ শান্ত। তুমি যেমন বলেছিলে ঠিক দু’ঘন্টা অন্তর খাইয়ে দিয়েছি দিদি।বেশ ঘুমোচ্ছে।
মেয়ের জামাকাপড়,কাঁথা সব সুন্দর করে গোছগাছ করে ওর বাস্কেটে তুলে রেখেছে সুপ্রিয়া। স্বাধীনতার বাড়িতে পরার নাইটি,অলোকের পাজামা,গেঞ্জিও আলনাতে তুলে রেখেছে।যাক্ মেয়েটি বেশ ভাল–পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন।আর সব বাইরের কাজের লোকের মতো অপরিচ্ছন্ন নয়।
রাতের রুটি তৈরি করে গিয়েছিল সুপ্রিয়া।রাতের খাওয়া অনেকক্ষণ হয়ে গেছে।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে কিছুটা অলসভাবেই একটা সিনেমার ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছিল অলোক।তার দু’চোখ সেঁটে গেল এক নায়িকার বক্ষস্থলে —সু উচ্চ দুই পর্বতের মধ্যিখানে গিরিখাত।
অলোক যেন উচ্ছ্বাসে টগবগ করছে, আরিবাস ! কি বুক মাইরি!
স্বাধীনতা ঘুম পাড়াচ্ছিল মেয়েকে।অলোকের মুখে এরকম কথা শুনে তার খুব খারাপ লাগছিল।একজন শিক্ষকের মুখে এই কথাগুলো মানায়?
অয়েল ক্লথের উপর কাঁথা বিছিয়ে মেয়েকে সরষের বালিশে শোয়াতে শোয়াতে সে একবার বিরক্তিভরে তাকাল অলোকের দিকে। তাদের ভট্টাচার্য্য পাড়ার বাড়িতে কখনো সিনেমার ম্যাগাজিন আসতো না। বাবা এসব পছন্দ করতেন না।
ছোটবেলায় বাবা সন্দেশ পত্রিকা আনাতেন কলকাতা থেকে। বাবার কড়া শাসন ছিল।পড়াশোনার আগে সে বই ধরা যাবে না। পড়াশোনা শেষ করে সে আর দাদা হুমড়ি খেয়ে পড়ত সেই বই।কত মজার মজার গল্পে মন ভরে যেত।