জগন্নাথের ইচ্ছে নিরঞ্জন ঘোষ।

জগন্নাথের ইচ্ছে
নিরঞ্জন ঘোষ।

রাস্তাটা বেঁকে গেছে এখানে। রাস্তার ধারের বেল গাছ়টা পেরিয়ে একটু এগিয়েই হারু ভটচাযের চোখ চলে গেল বাঁয়ে, মন্টু পোড়েলের বাড়ীর দিকে।পরিচিত দৃশ্য। প্রায় পনের দিন ধরে দেখছে, শীতের শুরু থেকে।
এই দৃশ্যটা দেখলেই মাথার ভেতরে পাকানো সলতেটায় দপ করে আগুন ধরে যায় হারুর। মনে মনে অনুচ্চ স্বরে মন্টুকে গিন্নীর ভাই সম্বোধনে আপ্যায়িত করে।

দৃশ্য মানে বিরাট কোন কিছু ব্যাপার নয়। শীতকালের ঠিক এই সময়টা, মানে বেলা বারটা নাগাদ উঠোনের রোদ্দুরে খাটিয়া পেতে মন্টু বসে থাকে, আর জানকী, মন্টুর বউ মন্টুর পিঠে তেল মাখিয়ে দেয়। রাস্তা দিয়ে যেই যায় সেই দেখে। গ্রাম দেশে এই দৃশ্য সহজলভ্য নয়। অন্ততঃ কম বয়সী স্বামী স্ত্রী হলে। মন্টু এখন আঠাশ আর জানকীর বাইশ তেইশ। ওরা দুজন ষাটের কাছাকাছি হলে কেউ এত মাথা ঘামাতো না। পাড়ার ছেলে ছোকরারা ওদের দুজনকে নিয়ে একটু বেশী গ্রামীন অপশব্দ ব্যবহার করে। অল্প বয়সি মেয়ে বৌয়ের দল হাসাহাসি করে। মন্টু অনেকদিন জানকীকে বারণ করেছে। কিন্তু সে শুনলে তো। সে তার পতি দেবকে তেল মাখাবেই। ওটা নাকি তার অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে পডে। গত দুবছর ধরে চলছে।

আর একটা জিনিষ এই গ্রাম দেশে সহজলভ্য নয়। সেটা হল খাটিয়া। এটা পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম। একদম পাড়াগাঁ। পুরুতগিরি করতে হারুকে নয় নয় করে গোটা পনের গ্রাম ঘুরে বেড়াতে হয়। ও কোথাও কোন গ্রামে এই খাটিয়া দেখেনি। এটাও বছর দুয়েক আগে এসেছে মন্টুর বাড়ীতে। এসেছে মানে জানকীর ফরমাইশে নবা মিস্ত্রী কুল কাঠের এই খাটিয়াটা তৈরী করে দিয়েছে। পাটের পাকানো দড়ি দিয়ে জানকী নিজে হাতে বুনেছে এই খাটিয়াটা।

সে যাকগে। কিন্তু হারু ভটচাযের রাগের কারণটা কী? কারণ টা আর কিছুই নয়। পুরুত মশাইয়ের কিছু আমদানী কমে যাওয়া। মন্টুর বিয়ে ঠিক মতো হলে, দু পক্ষ থেকেই লক্ষী আসত। সেটা আসেনি। কোন পক্ষ থেকেই আসেনি। তবে হ্যাঁ, বামুনের খ্যাঁটনটা ভালই হয়েছিল। সেই দিক দিয়ে মন্টু কাউকে বঞ্চিত করেনি।

মন্টুর বউ রয়েছে। অথচ ঠিকমতো বিয়ে হয়নি। কিরকম ধোঁয়াশা থেকে গেল, তাই না?

মন্টুর বউ জানকী। তবে প্রথম বউ নয়। এটা তার দ্বিতীয় বউ।
যখন মন্টুর প্রথম বিয়ে হয়েছিল তখন তার বয়েস বাইশ। মা নেই। বাপও কিছুকাল আগে গত হয়েছে। তবে মামার বাড়ী আসা যাওয়া ছিল। থাকার মধ্যে ছিল মন্টুর এক পিসি। যেটুকু জমি জায়গা ছিল, তাতেই দুজনের চলে যাচ্ছিল। পুজোর পর মুসুরির বীজ আনার জন্য মামার বাড়ী যাওয়া। ফিরে এল মুসুরির বীজ, জামাকাপড় ভর্তি একটা চামড়ার সুটকেস আর একটা আঠের বছরের বউ কে নিয়ে। সে আবার তার বড় মামীর কিরকম ভাইঝি। পাঁচ দিনের মধ্যেই বড়মামী মন্টুর বিয়ে দিয়ে ভাইঝিকে পাঠিয়ে দিলেন সংসার করতে। এ তরফ থেকে কেউ বলার ছিল না, বাধা দেওয়ারও ছিল না, পিসি ছাড়া। পিসি কোন কিছু বলা তো দূরের কথা, নতুন পুতুলকে হাতে পেয়ে খুশীতে ডগমগ হয়ে উঠলেন। গ্রামের লোকেরা বরযাত্রী যেতে পারল না ঠিকই, তবে বউভাতের খাওয়া কব্জী ডুবিয়ে খেল।

বছর চারেক খুবই আনন্দে কেটে গেল। তারপর, সেই যে বছর চারদিকে বন্যা হয়েছিল সেই বছরের কথা। সেদিন খুবই বৃষ্টি হচ্ছে। রাতের খাওয়া সেরে একটু বাইরে যাবার প্রয়োজন হল যমুনার। ও ব্যবস্থা উঠোনের ওদিকে। হাতে লন্ঠন নিয়ে গেল। ঘুরে আসার সময় উঠোনের জমা জলের মধ্যে দিয়ে না এসে দাওয়ার ধার ধরে একটু উঁচু জায়গা দিয়ে আসতে গেল। দেখতে পেল না। পা দিয়ে দিল গোখরোর গায়ে।

শক্ত কটা বাঁধন দিয়ে সারা রাত বউকে ফেলে রাখল মন্টু। কিছু করারও ছিল না। সকালবেলা, তখন বৃষ্টি কিছুটা কমেছে, বউকে কাঁধে ফেলে মাইলখানেক দূরে হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে ফেলল। ডাক্তারবাবুরও কিছু করার ছিল না। যমুনা অনেক আগেই মন্টুকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে।

প্রথম প্রথম কিছুদিন মনমরা হয়ে কাটল। তারপর চাষের কাজে নিজেকে পুরো লাগিয়ে দিল মন্টু। অন্য কোন দিকে মন দিল না।

গ্রামে শুভান্যুধায়ীর কোন অভাব নেই। মন্টুর ঘর নতুন করে বসাবার জন্য অনেকেই উঠে পড়ে লাগল। হারু ভটচায পুরুতগিরির পাশে পাশে ঘটকালিও করত। সে প্রায় সকাল বিকাল যাতায়াত শুরু করে দিল। ওদিকে মামাবাড়ির দিক থেকেও মাঝে মাঝে ছোটমামা আসতে শুরু করল। ছোটমামীর কে যেন আছে দূর সম্পর্কের বোনের মত। মামাদের ইচ্ছে ছেলেটা যেন আবার সংসার ফিরে পায়। পিসিরও সেই ইচ্ছে। কিন্তু মন্টুর কোন উৎসাহ নেই।

একদিন বিকেল বেলায় হারু ভটচায পিসি কে গোটা কতক ছবি দেখিয়ে কানে কিছু গুজগুজ ফুসফুস করে গেল। সন্ধ্যেবেলা ভাইপোকে একবাটি মুড়ি, তেল লঙ্কা পিঁয়াজ দিয়ে মেখে হারুর সামনে রেখে বলল, “বাপ আমার, এবার আমাকে ছাড়।“

সবে মাত্র একমুঠো মুড়ি হাতে তুলেছিল মন্টু। হঠাৎ এ কথা শুনে পিসির দিকে তাকিয়ে মানেটা বুঝতে চেষ্টা করল। তারপরই বলল, “কি ছাড়ব গো পিসি?”

“বলি আমাকে ছাড়, আমাকে। আর কতদিন বুড়ি পিসি কে দিয়ে রাঁধাবি? এবার আমাকে মুক্তি দে। একটা বিয়ে থা কর, আমি আর পারছি না বাপু।“

পিসির মুখ চোখ ভাল ঠেকল না মন্টুর। বুড়ি এবার খেপেছে। কিন্তু আবার বিয়ে? ভেতরের অনিচ্ছাটা কিছুতেই ইচ্ছা হয়ে বেরিয়ে আসছে না। আপাতত পিসিকে সামলানো দরকার। বিয়ের সম্বন্ধে পরে চিন্তা ভাবনা করা যাবে।

দু মুঠো মুড়ি চেবানো হয়ে গেছে। মাথায় একটা বুদ্ধিও এসে গেছে।

“পিসি, তার চেয়ে চল মহাপ্রভু দর্শন করে আসি। এসে এসব চিন্তা ভাবনা করা যাবে। এখন আলু বসানোর তাড়া নেই। হয়ে গেছে। কিষেন গুলো চার পাঁচ দিন জমি গুলো দেখে নিতে পারবে। নিমাই দাদারা বাস ছাড়বে। ওদের সঙ্গে চল পুরী ঘুরে আসি।“

“না বাপু, আমি বাসে যেতে পারব না। মাথা ঘোরে, বমি পায়। টেরেণে যাব।“ পিসির অনেকদিনের ইচ্ছে জগন্নাথ দর্শনের, হয়ে ওঠেনি। কারণ এদিকের সবাই দল মিলে বাসে যায়, আর পিসি বাসে যেতে একদম ইচ্ছুক নয়।

পরের দিন সক্কাল বেলাই মন্টু টাকা দিয়ে এল অশোক মাইতি কে। ও একদিন অন্তর কোলকাতা যায়। পুরীর টিকিট কিনে এনে দেবে।

ভাল ভাবেই পিসি ভাইপো দুজনে পুরী পৌঁছে গেল। নিমাই দাদার কাছ থেকে পান্ডার ঠিকানা এনেছিল। সেখানেও ঠিক মতো পৌঁছে গেল দুজনে। পান্ডার অনেকগুলো ঘর। নানা যাত্রী আসে যায়। তারই একটাতে ঠাঁই নিয়ে পিসি ভাইপোর জগন্নাথ দর্শন, সমুদ্র দর্শন এই সব করে দুটো দিন ভাল ভাবে কাটল। পিসি ভাইপোর বিয়ের কথা বেমালুম ভুলে গেল।

কিন্তু ভুললেন না একজন। স্বয়ং জগন্নাথ দেব। কে বলে তার হাত নেই? তাঁর ইচ্ছেয় কি হয় না? মন্টুর জীবন সঙ্গিনী যোগাড় তাঁর কাছে কোন ব্যাপারই নয়।

দ্বিতীয় দিনের দিন পাশের ঘরে এল এক মাঝবয়সি বিহারী সাথে বড় বড় ঘোমটা টানা দুইজন মহিলা। তারা জগন্নাথ দর্শন করে ফিরে আসার পর দুপুর বেলায় আলাপ হয়ে গেল। সাধারণ বিহারী পরিবার। নিজে থেকেই মন্টুর সঙ্গে আলাপ করল ভাঙা ভাঙা বাংলা আর হিন্দী মিশিয়ে। দ্বারভাঙ্গার লোক, একটু একটু ভাঙা বাংলা জানে।
“আর বোলেন না বাবুজী। হামারা ঘর তো দ্বারভাঙ্গা পড়তা হ্যায়। ভুবনেশ্বর আনেকো পড়া। তো সোচা, ইতনা নজদিগ যব আহি গয়া, তো জগরনাথ দর্শন ভী হো যায়।“
“ভুবনেশ্বর কেন?”
“ও ভী এক কিস্সা আছে বাবুজী। ও যো লেড়কী হ্যায় না, হমারা সাথ, ও মেরে ভাতিজী হ্যায়। উসকা মরদ কো খোঁজনে ভুবনেশ্বর আয়া।“
অনেক কষ্টে কলিঙ্গ প্রান্তে বাংলা হিন্দীর যৌথ মহড়ায় সন্ধি হয়ে বিহারীবাবুর বক্তব্যের মর্মার্থ উদ্ধার হল।

ওদের দেশের প্রথা অনুযায়ী, আট বছর বয়েসে মেয়েটার বিয়ে হয়েছিল গয়ার একটা ছেলের সাথে। বিয়ের পর নিয়ম অনুযায়ী মেয়ে বাপের বাড়ী ছিল। ষোল বছর বয়েস হলে গওনা হয়ে শ্বশুর বাড়ী যাবার কথা। তা ষোল বছর বয়স ঠিক সময়েই এসেছিল, কিন্তু গওনা হল না। ছ মাস আগে বাপ মা দুজনেই কি একটা অজানা রোগে এক দিনের ব্যবধানে মরে গেল। ঐ বছর গওনা হল না। মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে কোন তাড়াও এল না। গওনার খরচা তো কাকাকেই করতে হবে। আরও এক বছর বাদে, মেয়ে তখন আঠেরো, কিছু টাকা পয়সা যোগাড় করে শ্বশুর বাড়িতে চিঠি লিখল কাকা। কোন উত্তর এল না। শেষে একদিন গয়া চলে এল লেড়কার বাপের সঙ্গে কথা বলতে। ঠিকানাতে গিয়ে দেখল ওখানে কেউ নেই। অনেক খোঁজ খবর করে জানতে পারল লেড়কার ভুবনেশ্বরে কোন কোম্পানীতে নোকরী হয়ে গেছে, ওরা সবাই এখানকার পাট উঠিয়ে ভুবনেশ্বর চলে গেছে।
মাথায় হাত। তারপর অনেক কষ্টে ছেলের বাড়ীর এক আত্মীয়ের সন্ধান পেয়ে ভুবনেশ্বরের কোম্পানীর নাম যোগাড় করেছে কাকা। তারপর দেশে গিয়ে গিন্নী আর ভাইঝিকে সঙ্গে নিয়ে ভুবনেশ্বরে এসেছে জামাইকে খুঁজতে।
“আপনার জামাইয়ের দেখা পেলেন?”
“নহী বাবুজি। বদনসীব ভাতিজী। কোম্পানী মিলা। দো দিন অফিস মে বাবু লোগোঁকে পাস গিয়া। খবর মিলা নহী। লেড়কা কা নাম সে কোই কাম করে না। আব জগরনাথ পরভু ভরসা।“

তিন দিন হয়ে গেল পুরী তে। পান্ডা অনেক করেও অন্যান্য দর্শনীয় স্থান দেখার ব্যাপারে ওদের রাজী করাতে পারেনি। বাসে চাপলেই পিসির শরীর খারাপ হয় সেটা মন্টু ভাল ভাবেই জানে, তাই রাজী হয়নি।
শেষ দিনে সমুদ্রে স্নান করতে গেল না মন্টু। ঘরেতেই স্নান সেরে পিসিকে নিয়ে বাজারে বেরিয়ে কিছু কেনাকাটা করল। তারপর একটা হোটেলে নিরামিষ খাবার খেয়ে বারটা নাগাদ আস্তানায় ফিরে এল।
সবে এসে বসেছে। পান্ডার গলার উঁচু আওয়াজ আর একটা মেয়েলি কান্না শুনতে পেল মন্টু। কৌতুহলে বিহারীবাবুর ঘরটার দিকে পা বাড়াল।
পান্ডা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলছে কামরা খালি করে দাও, এক্ষুনি। উত্তরে একগলা ঘোমটা দেওয়া মেয়েটা জোরে জোরে কেঁদেই চলেছে। ঘরে আর কেউ নেই। তাড়াতাড়ি পিসিকে ডেকে আনল মন্টু।
কি ব্যাপার?
বেশ অদ্ভুত ব্যাপার। সকালবেলাই পান্ডাকে ডেকে বিহারীবাবু ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে চলে গেছে। ঘর পরিষ্কার করার লোক ঘরে ঢুকে দেখে একটা মেয়ে ঘুমুচ্ছে। পান্ডাকে ডেকে দেখিয়েছে। পান্ডা কল্পনাও করতে পারেনি, এরা দলের একজনকে এইরকম ভাবে ছেড়ে চলে যেতে পারে। পান্ডা অবাক হয়ে কিছু জিগ্যেস করেছে মেয়েটাকে। মেয়েটা তার কান্না মিশ্রিত দেশোয়ালী হিন্দী দিয়ে পান্ডাকে কিছুই বোঝাতে পারেনি। শেষে পান্ডা নিজে থেকে বুঝেছে যে, কাকা কাকিমা ভাইঝিকে ত্যাগ দিয়ে পালিয়েছে।
মাথা নাড়ল মন্টু। এইজন্যই জগরনাথ পরভু ভরসা।
কিন্তু জগরনাথ পরভুর তো হাত নেই। কি হবে এখন?
জগন্নাথের নিজের হাত আছে কিনা জানা নেই, কিন্তু তাঁর ভক্তদের তো আছে। পিসি ঘরে ঢুকতেই মেয়েটা পিসির পা জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল।
কান্না বোধ হয় আলাদা একটা ভাষা। সার্বজনীন, সেটা সবাই বুঝতে পারে। পিসি হাত দিয়ে ঘোমটা সরিয়ে দেখলেন সুন্দর একটি অপাপবিদ্ধ মুখের উপর বড় বড় দুই চোখে বাঁধভাঙা জল। পিসির মনটাও জলের মতো গলে গেল। মেয়েটা সকাল থেকে অভুক্ত সেটা বুঝতেও তার দেরী হল না।
মেয়েটাকে হাতে ধরে নিজের ঘরে নিয়ে এলেন পিসি। মন্টুকে ডেকে বললেন, পান্ডাকে বলে দিতে যদি কেউ না নিতে আসে, তখন এই মেয়েটা আমাদের সঙ্গে যাবে। বাড়ীর ঠিকানাটা পান্ডাকে দিয়ে যেন বলে দেয় যদি পরে কেউ খোঁজ করে, তাকে যেন এই ঠিকানায় খোঁজ করতে বলা হয়। সাথে সাথে মন্টুকে কিছু খাবার আনার কথাও বলে দিলেন।

সন্ধ্যে ছটা পর্যন্ত কেউ খোঁজ করল না। রাত দশটা নাগাদ ট্রেণ। এবার বেরোতে হবে।
পিসি কোনক্রমে গ্রাম্য বাংলায় সাথে ইশারা মিশিয়ে মেয়েটাকে জিগ্যেস করলেন সে ওনার সঙ্গে যেতে রাজী কিনা। মেয়েটা মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল।
গাড়ী লেট ছিল না। মোটামুটি বেলা একটা নাগাদ বাড়ী পৌঁছে গেল মন্টু।
এই সময় গ্রামের রাস্তায় কেউ থাকে না। কাউকে কবে, কখন, কে, এ সব জবাবদিহি করতে হল না।

ঘরে ঢুকেই পিসি হুকুম করলেন, “তুই এখন বসিসনি। এক্ষুনি সাইকেলটা নিয়ে বাজারে চলে যা।“
“কেন?”
“তার আগে একটা কথা বল। আমাদের গাঁয়ের লোকেদের কাছে এই মেয়েটাকে নিয়ে অনেক জবাবদিহি করতে হবে। কি বলব তা জানিনা। কোথ্থেকে কি হবে জানি না। একটা উপায় আছে। তুই এই মেয়েটাকে বিয়ে করতে পারবি?”
“আমি? মেয়েটার তো স্বামী আছে।”
“ধুর, সেটা আবার বিয়ে নাকি। ও কোনদিন ওর স্বামীর মুখই দেখেনি। কি শান্ত সুন্দর মেয়ে তুই জানিস না, ও একদম আমার কেষ্ট ঠাকুরের রাধারাণি। ওর স্বামীকে খুঁজতে কে কোথায় যাবে? কাকা কাকিমা ফেলে পালিয়ে গেছে। শ্বশুর বাড়ীর লোকেরা খোঁজ রাখেনি। একটা নিষ্পাপ মেয়ে বিনা দোষে কষ্ট পাবে? কি ভাবে একে রাখব? আর ও তো আসলে আইবুড়োই আছে। আমরা তাড়িয়ে দিলে রাস্তায় কুকুর শিয়ালে ছিঁড়ে খাবে। সে আমি হতে দেব না।“
মন্টু মাথা নীচু করল। “তুমি আমাকে মায়ের মত সারাজীবন আগলে রেখেছ, মানুষ করেছ। তুমি যা বলবে, তাই হবে পিসি।“
“তাহলে বাজারে গিয়ে দুটো লাল রঙের শাড়ী আর এক বাক্স সিঁদুর নিয়ে আয়। আজকেই বিয়ে হবে। পাড়ার লোকেদের যা বলার আমি বলব।“

স্নান করে নতুন শাড়ী পরে দাঁড়িয়েছিল জানকী। মন্টুকে নিয়ে পিসীমা ঘরে ঢুকল।
“আমার সামনে তুই ওর মাথায় সিঁদুর তুলে দে। আমি ওকে কোনরকমে যা বোঝানোর বুঝিয়েছি। রাজীও হয়েছে। ও আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে ওর কাছে তুই দেবতা।“
ঘোমটাটা সরাল মন্টু। হরিণের মত শান্ত বড় বড় চোখ তুলে তাকাল জানকী। পিসি একটুকুও মিথ্যে বলেনি। রাধারাণি। আর দ্বিধা করল না মন্টু। জানকীর মাথাটা লালে লাল হয়ে গেল।

বৌভাতে সারা গাঁয়ের নেমন্তন্য ছিল। মন্টু কোন কার্পণ্য করেনি। মাছ মাংস মিষ্টি ঢালাও খাইয়েছে। কয়েকজন বয়সি মহিলা বিস্তারিত ভাবে ঘটনা জানার জন্য একটু বেশী ইচ্ছুক হওয়াতে পিসি জানিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং মহাপ্রভুর বড় পান্ডার ইচ্ছায় এই বিয়ে হয়েছে। তাঁর ইচ্ছাকে অমান্য করার সাহস পিসির হয়নি। সেই প্রসঙ্গ উঠলেই চোখ বন্ধ করে হাত জোড় করে নমস্কার করে পিসি।
মন্টুর খেয়াল একটু বেশীই রাখে জানকী। মন্টুর সেবা করার ব্যাপারে সে কারও বারণ শোনে না।মন্টুরও না। সেই জন্যই নবা মিস্ত্রী কে দিয়ে চারপাই তৈরী করিয়েছে।

এরকম একটা খাটিয়া তৈরী করালে কেমন হয় – ভাবতে ভাবতে হাঁটা দিল হারু ভটচায।
=================

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *