জীবনবিজ্ঞান সম্পর্কিত কিছু কথা- পর্ব ৮ ✍️ডরোথী দাশ বিশ্বাস

জীবনবিজ্ঞান সম্পর্কিত কিছু কথা- পর্ব ৮
✍️ডরোথী দাশ বিশ্বাস
শীতের পাতা ঝরানোর বেলা… রৌদ্র ঝিমোনো শীতল অভিব্যক্তি সমস্ত শীত ঋতু জুড়ে… আর থার্ড সামেটিভ ইভ্যালুয়েশন, দশম শ্রেনীর টেস্ট পরীক্ষা শেষে স্কুলে বড়োদিনের ছুটি, ছাত্র শিক্ষক সকলেরই ছুটি ছুটি মন…, গোধুলি বেলা …অস্তরাগ …কনে দেখা আলো …শ্রান্ত বিকেলের শেষে সন্ধ্যা নামার ছায়াবৃত্তে ফেরা… অপূর্ব এক ক্ষণ…. শুধু ছুটি নেই মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের। আমি একটানা ২৬ বছর জীবনবিজ্ঞান বিষয়ে পরীক্ষক ছিলাম। কয়েকটি পর্বে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের কথা বলবো। বলতেই হবে। ওদের উদ্দেশ্যে আমার প্রথম কথাই হলো পড়ো আর লেখো- ভালোবেসে তাই…
মাধ্যমিক পরীক্ষা মানেই জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা। একটা উৎসব উৎসব ব্যাপার। পরীক্ষার প্রথমদিন পরীক্ষার্থীদের তো বটেই, অভিভাবকদেরও উদ্বেগ থাকে চরমে। প্রথমদিন পরীক্ষাকেন্দ্রও সরগরম। সব বাধা অতিক্রম করে প্রতিবছর মোটামুটি মার্চের সপ্তম দিবস থেকে শুরু হয় পরীক্ষা। চলে মার্চের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা থাকে প্রায় এগারো বারো লক্ষ। এর মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা প্রায় ষাট শতাংশ, পরীক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা চার হাজারের ওপর। আমি বিশেষ করে তাদের কথাই বলবো যারা এইট্থ ক্লাসে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছিলো। তারপর মহামারী আবহের জন্য স্কুল বন্ধ, একবারে অফলাইন মোডে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। সে সময় শিক্ষক-শিক্ষিকারা অবশ্য একদম নবম ও দশম শ্রেনীর নিয়মিত অনলাইন ক্লাস করিয়েছেন, প্রত্যেকটি সামেটিভ নেওয়া হয়েছে, দশম শ্রেনীর টেস্ট পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে, খাতা দেখা হয়েছে, মার্কশীট দেওয়া হয়েছে নিয়ম করেই। স্বভাবতঃই পরীক্ষা চলাকালীন বিশেষ সাজো সাজো রব। শেষ হলেই প্রতীক্ষা শুরু, খাতা আসবে। সেটাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একটানা পঁচিশ বছর ধরে জীবনবিজ্ঞান খাতা দেখছি। এর মাঝে পক্স হয়েছে, হাত ভেঙেছে, শত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও “না” বলতে পারিনি। না বললেই বা শুনবে কে! পক্স হলো, গা হাত পা যা না ব্যথা, মাথা ব্যথায় একেবারে শয্যাশায়ী। ফোন করলাম হেড এক্সামিনারকে। উনি বললেন, “আপনি আসুন, আমি সজনে খাই নিয়ম করে।” ডাক্তার দেখিয়ে এতো আর এমন ওষুধ খেলাম যে ঐ অবস্থাতেই মেডিক্যাল লিভে থেকে খাতা দেখে ৫০ কিমি বাস জার্ণি করে পৌঁছে গেলাম হেড এক্সামিনারের বাড়ি, আবার ফিরে এলাম ৫০ কিমি, ব্রেক জার্ণি পুরোটাই। তিন তিন ছয়টি বাস পাল্টে, তিন তিন ছয় ঘন্টা সময় ব্যয় করে। তর্জনী ভাঙলো, তাইইই সই। এ পর্যন্ত প্রতিবার নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই খাতা দেখে দিতে সমর্থ হয়েছি। তখন তো মহামারী আবহ ছিলো না, তবু খাতা দেখে হাত ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে নেওয়াটাই রপ্ত করেছি সবসময়। তবু একবার খাতা দেখাও শেষ, শুরু হলো তীব্র ডায়েরিয়া। এক চামচ জল খেলে বমির মাধ্যমে এক গ্লাস জল বেরিয়ে যাচ্ছিলো। একে তো একশো কিমি জার্ণি করে পা সবসময় ফুলে থাকতো, তার উপর বাড়ি এসে বিছানায় আরাম করে বসে নয়, টেবিল চেয়ারে খাতা দেখা, পা ফুলে ঢোল হয়ে থাকতো। বারো ঘন্টা বাইরে থেকে, পরীক্ষার খাতার বোঝা মাথায় নিয়ে বেলায় বেলায় শুধু সেদ্ধ ভাত ছাড়া আর কিছু রান্না করার সময় থাকতো না। কি চরম কষ্ট করেছি ডেইলি প্যাসেঞ্জারির এগারো বছর, তা বলে বোঝানো যাবে না। তবু একবারও ভুলক্রমেও ছাড় পাইনি। উদ্যমের খামতি ছিলো না কখনো। দায়িত্ব বলেই সেটা গুরুত্ব দিয়ে পালন করেছি সবসময়। চরম ব্যস্ততা, তবু যখন খাতা দেখা শেষ হয়ে যেতো তখন মনে হতো,”অবশেষে শেষ হলো তাহলে!” খাতা দেখলে নিজে আপডেট থাকা যায় অনেক বেশি। এটা বুঝেছি। খাতা দেখতে গিয়ে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে যে ত্রুটিবিচ্যুতি দেখেছি সেসব স্কুলের টেন্থ ক্লাসের মেয়েদের বলেছি। জানি এভাবে ওরা সংশোধন করেছে নিজেদের।
এ যাবৎকাল পাঁচজন হেড এক্সামিনারকে পেয়েছি। তাঁরা প্রত্যেকে আমার খাতা দেখার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আজ পর্যন্ত কোনো খাতা চ্যালেঞ্জ হয়নি। স্ক্রুটিনি করে নম্বর বাড়েনি, বা রিভিউ হয়নি। বিগত ২৪ বছরে পেয়েছি এমন খাতার সংখ্যা ছিলো ১৫০ – ২০০ এর মধ্যে। অতিমারীবছরে সেই সংখ্যা ২২৬, আমার সহকর্মী বন্ধুরা জিজ্ঞেস করলে এই সংখ্যা বলেছি, ওরা বলছে, একশো ছাব্বিশ? আরে না, না। দু’শো ছাব্বিশ। শুনেই অবাক। যাক্! আমার ভাগ্যই এমন। কর্ম করতে বা দায়িত্ব পালন করতে ভয় পাই না, অনিচ্ছুকও নই, তাই বলে সবসময় ওভার লোড!!! এ কেমন ভাগ্য!!! সংখ্যা দেখে ঠিক করেই নিলাম, একদম মেডিক্যাল লিভ নিয়ে দেখবো। অনেক হয়েছে। অনেএএএএক কষ্ট করেছি। খাওয়া নেই দাওয়া নেই মাইলের পর মাইল জার্ণি, তাও ডিরেক্ট বাস নেই, সাড়ে চারটে পর্যন্ত স্কুল করে তারপর রাত আটটায় বাড়ি, স্নান, কাপড় কাচা, রাতের রান্না, তারপর রাতে ঘন্টা চারেক একটানা খাতা দেখা। অবশ্যই বোর্ডের নির্দেশ হুবহু মেনে আমার যা খাতা দেখার পদ্ধতি, তাতে একটা খাতা দেখতেই পৌনে দু’ঘন্টা। রাত দুটোয় ঘুমোতে যাওয়া, ভোর চারটেতে উঠে রান্না, যাতে বিকেল চারটে পর্যন্ত খাদ্য বিষয়ে পরিবারের সবাই নিশ্চিন্ত থাকে। এই হলো রুটিন। বেশ কিছু খাতা দেখে যখন সরগড় খানিকটা, পরীক্ষার্থীদের ধাঁচ বুঝতে যখন পেরেছি প্রায় তখন বেছে বেছে একরকম দশটি খাতা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে যেতাম স্কুলে। অফ পিরিয়ডে অব্যবহৃত ক্লাসরুমে বসে দেখতাম ঐ খাতাগুলো। নিজ দায়িত্ব, কখনোই ভুলিনি সে কথা। ক্লাস করতাম যখন তখনও ব্যাগ হাতছাড়া করিনি। কারণ খাতা আছে ব্যাগে। সহকর্মীদের থেকে কথাও শুনেছি। কিছু বলিনি। আমি জানি, আমি কতটা সিমপ্যাথি নিয়ে, কতটা দায়িত্ব নিয়ে পরীক্ষার্থীদের খাতা দেখি। কর্ম সম্পাদন সঠিক ভাবে করতে চাইলে কথা কম। এটা বিশ্বাস করি। সেবছর আমার হেড এক্সামিনার নতুন, অনেক জুনিয়ার। উনি অবাক হয়ে গেছেন আমার খাতা দেখা দেখে। বলেছেন, ” আমার একজন এক্সামিনারও আপনার মতো এতো সুন্দর খাতা দেখেনি …..” যাই হোক্, এমন কথা শুনলে কার না আনন্দ হয়! অনেকবার ভেবেছি, খাতা দেখার অভিজ্ঞতা লিখে রাখবো, কিন্তু কোনোবারই সে ইচ্ছে পূরণ হয়নি। তবে আমি সেবারের অভিজ্ঞতা লিখবোই ঠিক করেছিলাম, একদম আমার বিষয়ের প্রশ্নপত্র ধরে ধরে যদি কারো কাজে লাগে!
(ক্রমশঃ)
শব্দ সংখ্যা: ৭৯৭