প্রেমের অর্ধবৃত্ত ✒️✒️ মৃত্যুঞ্জয় রায়চৌধুরী

প্রেমের অর্ধবৃত্ত

মৃত্যুঞ্জয় রায়চৌধুরী

মহেন্দ্র বাবুর রাতে এখন ঠিক ঘুম হয়না, ঐ কখনো চোখ বুজে, কখনো চোখ খুলে পড়ে থাকেন আর বার বার বাথরুমে যেতে হয়। তবে খুব সন্তর্পনে বিছানা থেকে নেমে যখনি বাথরুমে যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েছেন অমনি সতর্কবাণী, “লাইট জ্বালালে না? লাইট জ্বালাও , আর দেওয়াল ধরে ধরে যাবে কিন্তু। দেখো, বাথরুম টা একটু পিছল হয়েছে খুব সাবধানে যাবে, কিছু অসুবিধা হলে ডাকবে।”
এতো সাবধানে বিছানা থেকে নেমে রমা দেবীর ঘুম ভেঙে যাবার ভয়ে লাইট অবধি জ্বালাতে চান না, কিন্তু রমা যেন অতন্দ্র প্রহরী। তখন লাইট জ্বালিয়ে হেরো সৈনিকের মতো মুখ করে একবার ঘুরে দেখে নেন। বিছানায় পড়ে আছে রোগ ভারে শীর্ণ নিথর এক শরীর , কেবল পাখার হাওয়ায় চুল গুলো অল্প অল্প নড়ছে। ভালো লাগছে দেখতে কিন্তু বেশীক্ষন তো দেখার উপায় নেই। পট্ করে চোখের পাতা খুলে যাবে, তখন শক্ত চোয়াল, অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে এমন সব তীক্ষ্ণ বাক্যবান চয়েস করে ছুড়বে যে রোমান্স লবনজল হয়ে ঘর ভাসিয়ে দেবে।
মাঝে মাঝে ভাবেন এই মহিলা কে নিয়ে পঞ্চাশ বছর কাটালেন কিভাবে? এখনো মাঝে মাঝে মন পরিত্রাণ পেতে চায়না বললে একেবারে মিথ্যা কথা বলা হবে। কিন্তু ঐ এক হিসাব, যেভাবে পঞ্চাশ বছরের প্রতিটি দিনের পাওয়া না পাওয়ার হিসাব কষেছেন, সেই এক হিসাবেই পা আটকে গেছে বারবার। সকালে চিনিছাড়া চা নিয়ে বিছানায় হাজির হওয়া, সঙ্গে এক বাটি গরম জল কাঁধে গামছা।নিজে হাতে চোখ মুখ হাত পা ঘাড় মুছিয়ে দেয়া। খাবার আগে ওষুধ হাতে ধরিয়ে দিয়ে জলের গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। আর ভাবতে পারেন না, স্নেহের বেড়াজালকে নাগপাশ ভেবে যতবার সাহস সঞ্চয় করে ছিঁড়ে বেরোতে গেছেন মনে হয়েছে এর বাইরে গেলে আর বেশি দিন বাঁচবেন না, তখন কিঁউ কিঁউ করতে করতে আবার ল্যাজ গুটিয়ে পায়ের কাছে হাজির হয়েছেন। কিড়িং কিড়িং…
“বাবা, মা কি করছে? মাকে সারপ্রাইজ দাও, আজকে যে তোমাদের গোল্ডেন ম্যারাজ এনিভার্সারি।”
উঃ এটা একটা ফোনের সময় ?ফোনটা কেটে দিলেন। তবুও ছেলের ফোন কিনা,খুব আস্তে একবার ডাকলেন,” রমা, তুমি ঘুমচ্ছ ?” কোন সাড়া নেই, বুঝলেন ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় একটু আরাম পেয়ে ঘুম টা গভীর হয়েছে। জানলা দিয়ে শীতল মৃদু আলোটা ওর শান্ত সুন্দর মুখের উপর এমন ভাবে পড়েছে, একটা সুপ্ত ইচ্ছা জেগে উঠল। দেহ রোমাঞ্চিত হলো। কিন্তু তৎক্ষণাৎ পরের মুহূর্তের বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া কল্পনা করে তা আর স্থায়ী হতে পারল না। কেমন যেন মিঁউ মিঁউ করে ল্যাজ গুটিয়ে সরে এলেন। সত্যিই তো এই পঞ্চাশ বছরে রমার কাছ থেকে তো কম কিছু পাননি। মনে হলো বিয়ের পর থেকে ও কেবল দিয়ে ই গেল। একটা একটা করে ছবির মতো ভেসে উঠলো সব। বড়ো ক্লান্ত লাগছে, পাওনার ভারে ক্লান্ত। হঠাৎ যেন তাঁর শরীরে শক্তি ভড় করলো। ঝপ্ করে বিছানা থেকে নেমে পড়লেন। পঞ্চাশ বছর, গোল্ডেন জুবিলী অব ম্যারাজ এনিভার্সারি।একটা প্রতিদান দিতে ই হবে। এই পঞ্চাশ বছরের একতরফা ভালোবাসার ঋণ মেটানোর সময় এসেছে। তুমি শুয়ে থাকবে। তোমার কোনো কথা আজ থেকে আমি শুনব না। চোখ রাঙিয়ে তোমাকে শাসন করব, তোমাকে ও নিতে হবে আমার ভালোবাসা। এই চললাম চা তৈরি করতে। তারপরে দেখা যাবে কত ধানে কত চাল।
বিছানার সামনে দাঁড়ালেন,দেখো ঠিক তোমার মত সেজেছি, কাঁধে গামছা, একহাতে গরম চা, অন্যহাতে ওষুধ, জলের বোতল। তোমাকে ওষুধ খাইয়ে গামছা জলে ভিজিয়ে তোমার নরম ঠোঁট দুটি আলতো করে মুছে চিবুক ছুঁয়ে,চোখ দুটো কে একটু ঠাণ্ডার আবেশ মাখিয়ে… কিন্তু একি ,মাছি! মাছি কোত্থেকে এলো! তোমার ঠোঁটে মাছি! রমা, তোমার ঠোঁটে মাছি কেন? রমা, রমা, রমা তোমার ঠোঁটে মাছি বসছে তুমি তাড়াও, আমার যে দুহাত জোড়া। ও রমা ওঠো, বসো, চোখ মেলো। আজকে একবার শুভদৃষ্টি হবে না রমা? আজকে যে আমাদের হ্যপি গোল্ডেন জুবিলী…আজকে আমাদের হ্যপি গোল্ডেন…
বুকফাটা কান্নার শব্দ ফাঁকা ঘরগুলোর দেওয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে মিলিয়ে গেল, দুটো কপোত- কপোতি তাদের বকবকম থামিয়ে ঝটপট্ ডানার ঝাপটায় অন্যত্র সরে গিয়ে অখণ্ড নীরবতা নামিয়ে আনল। সূর্যের রোদ বেশ চড়েছে, রমার তাতে কোনো হেলদোল নেই। মহেন্দ্র বাবুর বুকের নিচে চাপা পড়ে রইল এক অর্ধবৃত্ত ভালোবাসা।

1 thought on “প্রেমের অর্ধবৃত্ত ✒️✒️ মৃত্যুঞ্জয় রায়চৌধুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *