গিরিশ ঘোষ ও তার নাট্যচর্চা ✒️পাপিয়া সাহা

গিরিশ ঘোষ ও তার নাট্যচর্চা

✒️পাপিয়া সাহা

পূর্ব প্রকাশিতের পর
সপ্তম পর্ব

ভারতবর্ষ সেই সময় এক পরিবর্তনশীলতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। পশ্চিমী শিক্ষা এবং ধর্ম তরুন সমাজকে প্রবলভাবে প্রভাবাণ্বিত করছিল।তারা সনাতন ধর্ম বিশ্বাসের ওপর সংশয়াচ্ছন্ন ছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষক এবং খ্রীষ্টান মিশনারীদের সান্নিধ্যে এসে হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস হারিয়ে ধর্মীয় বিশৃঙ্খলার মধ্যে উদভ্রান্ত হয়ে পরেছিল। এই সংশয়ের মুখে গিরিশ চন্দ্র ক্রমে ক্রমে নাস্তিকে পরিনত হয়ে পরেছিলেন। ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধু কালীনাথ বসুর মতে এ সত্ত্বেও তার অন্তরে আধ্যাত্মিকতার একটা চোরা স্রোত বইত।গিরিশ চন্দ্র নিজে মদ্যপানে অভ্যস্ত ছিলেন, কিন্ত বন্ধুবান্ধবদের মদ্যপ অবস্থায় দেখতে পছন্দ করতেন না। মানসিক গঠনের দিক থেকেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত কোমল। যে কোনও অপরাধীকে তিনি দণ্ড দানের চাইতে ক্ষমা করারই পক্ষপাতি ছিলেন।
গিরিশ চন্দ্র কালীনাথের সঙ্গে একবার ব্রাহ্ম সমাজের প্রার্থনা সভায় উপস্থিত হন।সেখানে মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর,রেভারেণ্ড বেচারাম এবং পূর্ব বঙ্গের এক প্রচারকের বক্তৃতা শুনেছিলেন। কেশব চন্দ্র একটি প্রতিদ্বন্দী ব্রাহ্ম সমাজের নেতা ছিলেন। তিনি ঐ প্রচারকটি সম্বন্ধে বিরোধী ও অনুদার মন্তব্য করলেন। তরুন গিরিশ কোনও ভণ্ডামি পছন্দ করতেন না। তিনি বুঝলেন যে ওই সমস্ত নেতাগন মুখে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের কথা বলে বটে কিন্ত আসলে একে আন্যের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ভাব পোষন করেন। সেই থেকে তিনি দ্বিতীয় বার আর ব্রাহ্ম সমাজের অধিবেশনে পদার্পন করেন নি। আটত্রিশ বছর বয়সে কালীনাথের জীবনাবসান হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাবে গিরিশ চন্দ্রের রূপান্তর দেখে যেতে পারেন নি তিনি। নাস্তিকতা হল আত্মার অসুখ। ইতিবাচক মনোভাব দিয়ে নেতিবাচক মনোভাব সমূলে উৎপাটিত করা যায়। গিরিশ চন্দ্রও তাই করেছিলেন। অবশেষে শ্রীরামকৃষ্ণের চরণে আশ্রয় লাভের পর গিরিশের ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাসের ওপর যবনিকাপাত হল।শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে গিরিশের যখন সাক্ষাত হয় তখন গিরিশের বয়েস চল্লিশ। তার বহু বিশ্রুত নাটক “চৈতন্য লীলার”মধ্যে দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে গিরিশের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। গিরিশ চন্দ্র তার নাটক গুলিতে শ্রীরামকৃষ্ণ কে আমন্ত্রণ জানিয়ে বাংলা রঙ্গমঞ্চকে এক মানব দেবতার পৃষ্ঠপোষকতা লাভের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। অভিনয় অনুষ্ঠানগুলির মাধ্যমে গিরিশ চন্দ্র কলকাতার বারবনিতার পল্লীতে শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুরের বানী পৌঁছে দিয়েছিলেন।

ক্রিস্টোফার ইশারউড লিখেছেন—সেই সময়ে বাংলা থিয়েটারের অভিনেত্রীদের বারাঙ্গণা ছাড়া আর অন্য কিছুই ভাবা হোত না।একই ধরনের সংস্কার ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রাক মুহুর্ত পর্যন্ত ইংল্যান্ডের দর্শক মনকেও প্রভাবিত করেছিল। এর আশ্চর্য ফলশ্রুতি হিসেবে এখন কোলকাতার প্রায় প্রতিটি থিয়েটারের মঞ্চের পেছনে শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের ছবি টাঙ্গানো থাকতে দেখা যায়। নট নটীরা মঞ্চে প্রবেশের পূর্বে নত মস্তকে তাকে প্রণাম জানিয়ে তবেই মঞ্চে প্রবেশ করেন। গিরিশ চন্দ্রের নাট্য শিল্পের চর্চায় তার অনুমোদন এবং অনুপ্রেরনা বাংলা রঙ্গমঞ্চের পৃষ্ঠপোষক দেবতা হিসেবে শ্রীরামকৃষ্ণের সুদৃঢ় অবস্থান ধরা পরে।

এখনকার দিনে থিয়েটার, অপেরা বা সিনেমায় যাওয়া কোনও নিন্দনীয় বা লজ্জার ব্যাপার নয়। বরং সাংস্কৃতিক ঘটনাবলীর অংশীদার না হওয়াটাই সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং সুরুচির অভাব বলেই ধরা হয়। কিন্ত শ্রীরামকৃষ্ণ কালীন সময়ে বাংলার গোঁড়া সমাজ, প্রগতিশীল ব্রাহ্ম সমাজ এবং সমাজের অন্যান্য অংশ থিয়েটার কে ঘৃণা ভরে পরিহার করত। কারন সে সময়ে অভিনেতা অভিনেত্রীদের নীতিহীন,সুরাসক্ত,লম্পট ও বারাঙ্গণার চেয়ে বেশি কিছু ভাবা হোত না। এরকম অবস্থায় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যিনি স্বয়ং ঈশ্বর জনিত পুরুষ এবং অবতার বলে বিবেচিত তিনি কিনা 1884 র 21 শে সেপ্টেম্বর ষ্টার থিয়েটারে এসেছেন গিরিশ ঘোষের চৈতন্য লীলা দেখতে। সেই সময়কার কিছু কিছু গোঁড়া এবং কঠোর নীতিবাগীশ বাঙ্গালীর কাছে তাকে সমালোচিত করে তুলেছিল। প্রথম প্রতিক্রিয়া এসেছিল ব্রাহ্মদের কাছ থেকে। ব্রাহ্ম সমাজের অন্তর্ভুক্ত বহু মানুষ তার সাথে সংস্রব ত্যাগ করেন। এর মধ্যে প্রোথিতযশা শিবনাথ শাস্ত্রী ছিলেন অন্যতম। যদিও কেশব চন্দ্র সেনের মৃত্যুর পর বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী তার একনিষ্ঠ ভক্তে পরিনত হন।

ঠাকুর একদিন মানব হিতৈষী অশ্বিনী দত্তের সঙ্গে গিরিশ চন্দ্র সম্পর্কে কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন যে গিরিশ মদ খায় বলে সকলের আপত্তি। তাতে কি সে খাক না কেন? কতদিন আর খাবে? বিষয়টা অত্যন্ত সহজ ভাবে মেনে নিয়েছিলেন। যেন মদ খাওয়াটা তার অন্য সৎ গুনাবলীর ধারে কাছেও না। রামকৃষ্ণ ঠাকুরের একনিষ্ঠ ভক্ত পরম বৈষ্ণব রামচন্দ্র দত্ত ঠাকুরের থিয়েটারে যাওয়াটা একেবারেই সমর্থন করেন নি। শ্রীম কথামৃতে লিখেছেন-মহেন্দ্র মুখুজ্জের সঙ্গে তার গাড়ি তে ঠাকুর চৈতন্য লীলা দেখতে যাবেন। তাতে কেহ কেহ বলিলেন ওতে বেশ্যারা চৈতন্য, নিতাই ইত্যাদি চরিত্রে অভিনয় করে। শ্রীরামকৃষ্ণ উত্তর করলেন আমি তাদের মা আনন্দময়ী দেখব। ঠাকুর ও তার ভক্তদের দীর্ঘদিন ধরে বিশিষ্ট নাগরিক ও সাধারণ সমাজের নানা বিরোধিতা ও সমালোচনার মুখোমুখী হতে হয়েছিল। এমন কি ঠাকুরের মহা প্রয়াণের পরেও মানুষ তার বিরুদ্ধে বলতে ছাড়েনি।

1896 সালে ম্যাক্সমূলার রামকৃষ্ণ জীবনীতে তাকে পরম শ্রদ্ধায় Real Mahatma বলে ঘোষনা করেছেন। তার কারন হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন—এক-ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ থিয়েটারের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।
দুই-মদ্যপ গিরিশ কে তার চরণে আশ্রয় দিয়েছেন –
তিন-বারাঙ্গণা অভিনেত্রীদের মস্তক স্পর্শ করে “চৈতন্য হোক” বলে আশীর্বাদ করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সত্য উপলব্ধির এই দিক গুলি যদি অপরাধ হয় তাহলে পৃথিবীর অন্যান্য মহামানব ধর্ম প্রবর্তকেরা ও এই অপরাধে অপরাধী। এই ভীষণ সরল সত্য কথা তিনি নির্ভীক কণ্ঠে জোর পূর্বক প্রতিষ্ঠা করেছেন। যাহারা নিজেদের মহাপণ্ডিত মনে করিয়া এই মূর্খ,দরিদ্র, ব্রাহ্মণ পূজারীর প্রতি উপেক্ষা দেখান সেই মূর্খ ব্রাহ্মণ পূজারিই কিন্তু সপ্ত সমুদ্র লঙ্ঘন করে আপনাদের পিতৃ পিতামহগত আরাধ্য সনাতন ধর্মের জয় ঘোষনা করিয়া অল্প সময়ের মধ্যেই নিজ শক্তিবলে গোটা বিশ্ব জগতে প্রতিধ্বণিত করিল। সেই রকম হে সর্বলোকমান্য শূরবীর মহাপণ্ডিত গন , যদি স্বজাতির কল্যাণে কিছু অদ্ভুত মহৎ কাজ সাধন করিতে পারেন, তবে বিলম্ব না করিয়া প্রকাশ করুন আপনাদের মহাশক্তির খেলা। আর যাহারা শ্রীরামকৃষ্ণ নামের প্রতিষ্ঠা ও প্রভাবে দাস জাতি সুলভ ঈর্ষা ও দ্বেষে জর্জরিত কলেবর হইয়া বিনা কারনে নিদারুণ বৈর প্রকাশ করিতেছেন তাহারা চৈতন্য হীন নিতান্তই অজ্ঞ।

জগতের ত্রাণ কর্তা অবতারেরা তাদের কোমল ক্ষমাশীল চারিত্রিক শক্তিবলে মানুষের চরিত্র পরিবর্তন করতে পারেন, পাপীকে সাধূতে রূপান্তরিত করিতে পারেন। ভগবান যীশুকেও এরকম বহু পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ঘৃনা দিয়ে ঘৃণা কে জয় করা যায় না।একমাত্র ভালবাসা দ্বারাই এটা সম্ভব। ভগবান বুদ্ধ জীবনের শেষ দিকে রাজগৃহ থেকে কুশীনগর চলে যান। সেখানে এক সুন্দরী নর্তকী অম্বাপালীকে রাজকীয় বিলাস বহূল সুখ সম্ভোগে পরিপূর্ণ জীবন থেকে এক পরম নিষ্ঠাবতী ভক্তিপূর্ণ সাধারণ নারী জীবন দান করেছিলেন ও ধর্মের অনুগামী করে তুলেছিলেন। বাইবেলে একটি কথা আছে গীর্জা সাধূদের জন্য নির্মিত জাদুঘর নয়, এটা হল পাপীদের আরোগ্য স্থল। যুগে যুগে অবতার পুরুষদের দয়া,করুণা,ক্ষমা ও ভালবাসাকে সভ্য সমাজ বিনা কারনে ভুল বুঝেছে।ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও সমালোচিত হয়েছেন। পরে পৃথিবীর সভ্য সমাজ উপলব্ধি করেছে। হজরত মোহাম্মদ ঈশার দয়াপ্রাপ্তা সামরীয়া নারীও একই ভাবে তার জীবন চরিত পরিবর্তন করতে পেরেছিলেন। যাহারা ঠাকুর ঘরে মন সমর্পন করিয়াও ওই বেশ্যা,ওই নীচ জাতি,ওই গরীব কাঙাল, ওই ছোটলোক এই ভেদ ভাব রচনা করে তাদের সংখ্যা জগতে যতই কম হয় ততই মঙ্গল। যারা ভক্তের জাত দেখে তাহাদের কি ক্ষমতা পরমঠাকুরের হৃদয়-ঐশ্বর্য উপলব্ধি করবার। বরং বেশ্যা,মাতাল,লম্পট, চোর,ডাকাত সকলেই তার চরণাশ্রিত হোক। সকলের জন্য তার হৃদয় দুয়ার যে অবারিত।
‘ It is easier for a camel to pass through the eye of a needle than for a rich man to enter the ‘ Kingdom of God’. বিচক্ষন গিরিশ চন্দ্র এটি খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *