জার্মানি: জাটিঙ্গার ফিনিক্স হয়ে ওড়া © সায়ন্তন ধর

জার্মানি: জাটিঙ্গার ফিনিক্স হয়ে ওড়া

©✍ সায়ন্তন ধর
(পঞ্চম পর্ব)

…এবার দেখব মিউজিয়াম। স্প্রী নদীর একটি দ্বীপের উত্তরাংশ মিউজিয়াম আইল্যান্ড নামে পরিচিত। ১৯৯৯ সাল থেকে এটি একটি হেরিটেজ সাইট। একাধিক ছোট ছোট মিউজিয়াম এর সমষ্টি এই মিউজিয়াম আইল্যান্ড। আল্টেস মিউজিয়াম, নিউয়েস মিউজিয়াম, আল্টে ন্যাশনাল গ্যালারি, বোডে মিউজিয়াম, পারগামন মিউজিয়াম ও জেমস-সাইমন গ্যালারি রয়েছে এখানে। ১৮৩০ থেকে ১৯৩০ সালের বিভিন্ন সময়ে প্রাশিয়ান সম্রাটের তত্ত্বাবধানে পাঁচজন আর্কিটেক্টের পরিকল্পনায় গড়ে ওঠে এটি। মিউজিয়াম গুলি যেমন সমৃদ্ধ তেমনি তাদের আর্কিটেকচার মুগ্ধ করার মত। প্রতিটি মিউজিয়াম একে অপরের সাথে ব্রিজ দিয়ে যুক্ত ছিল পরবর্তীতে প্রমেনেড তথা ভাসমান ফুটপাথের সাহায্যে যোগাযোগ রক্ষিত হয়। এই মিউজিয়াম আইল্যান্ডের দক্ষিণ অংশটি ফিশার আইল্যান্ড নামে পরিচিত। এখানে রয়েছে আকাশচুম্বী অট্টালিকার সারি। আর রয়েছে মাছ ধরার সুবন্দোবস্ত। এরকম সমৃদ্ধ একটি মিউজিয়াম একদিনে দেখে শেষ করা যায় না। আদিম পৃথিবী থেকে শুরু করে আধুনিক মানুষ ও তার সমসাময়িক কীর্তি সংরক্ষিত আছে। শিল্পকলা, স্থাপত্য, ভাষ্কর্য, চিত্র, বাদ্যযন্ত্র, যুদ্ধাস্ত্র, বৈজ্ঞানিক-ভৌগলিক-ঐতিহাসিক দলিল ও ভবিষ্যতের পৃথিবী তুলে ধরা হয়েছে চোখের সামনে। পুরো এক সপ্তাহ কাটিয়ে দিলাম এই দেখে। বার্লিনে রয়েছে স্টেট লাইব্রেরী, স্টেট অপেরা, বার্লিন ফিলহার্মোনিক। এখানেই বিশ্বের প্রাচীনতম পূর্ণদৈর্ঘ্যের সিনেমার স্টুডিও রয়েছে। বার্লিনের নৈশজীবনও বড়ই রঙিন তবে আমি ভালোবাসি নিশীথের আকাশ, তাই নদীর তীরে রেলিং এ হেলান দিয়ে মেঘমুক্ত রাতের জ্যোৎস্নালোকিত প্রকৃতি দেখে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে দিই। রাতটা জার্মানির আকাশে ক্যাসিওপিয়া দেখে কেটে গেলেও এত কিছু দেখার আছে যে কোনদিক দিয়ে সময় চলে যায়। এরপর এলাম বার্লিন মর্ডানিজম হাউসিং এস্টেটে। ১৯১৯-১৯৩৩ সালে বার্লিনে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। এ সময়ে নিম্নবিত্তের জন্য উদ্ভাবনী কায়দায় গ্রামীন বিকাশ এর মাধ্যমে ছয়টি স্থানে ভর্তুকিযুক্ত হাউসিং তৈরি হয়েছিল যার স্থাপত্য ও নান্দনিক মূল্য অপরিসীম। এছাড়াও এর নির্মাণের মহৎ উদ্দেশ্যের কথা চিন্তা করে এটিকে বিশ্বের একটি ঐতিহ্য মন্ডিত স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ব্রুনো ট্বট, মার্টিন ম্যাগনার ও ওয়াল্টার গ্রপিয়াস হলেন এই প্রোজেক্টের মূখ্য আর্কিটেক্ট। এর সাথে সাথে ঘুরে এলাম পটসডাম ও বার্লিনের রাজপ্রাসাদ ও তৎসংলগ্ন বাগান থেকে। সবুজ গালিচার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অপরূপ স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন একাধিক রাজপ্রাসাদ। রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা উঁচু হয়ে সবুজ বাগানটি রাজপ্রাসাদের ভূমি স্পর্শ করেছে। প্রাসাদ গুলির দেওয়ালের ভাস্কর্য দেখে দেখে কাটিয়ে দিলাম আরো একটি দিন। পরদিন এলাম জেন্ডারমেনমার্কট ঘুরে দেখতে। ১৬৮৮ সালে জোহান আর্নল্ড নেরিং এটি নির্মাণ করেন। বার্লিন কনসার্ট হলের ডানদিকে একটি ফ্রেঞ্চ চার্চ ও বাঁদিকে একটি জার্মান চার্চ রয়েছে। এরপর এলাম জার্মানির উচ্চতম, ইউরোপীয় ইউনিয়নের তৃতীয় উচ্চতম, এবং ইউরোপের চতুর্থ উচ্চতম টেলিভিশন টাওয়ারটির কাছে। ১৯৬৫-১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব জার্মানি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় এই ৩৬৮ মিটার উচ্চ টাওয়ারটি। সমগ্র বার্লিন থেকে লক্ষ্য করা যায় এটি আবার এর চূড়ায় উঠলে সমগ্র বার্লিন দেখা যায়। বার্লিন থেকে প্রতিটি দেশের রাজধানীর উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক ট্রেন ছাড়ে। শহরতলীতে রয়েছে U-Bahn ট্রেন ও শহরের পাতালরেল গুলিকে S-Bahn বলে। জার্মানি পৃথিবীর প্রথম ট্রাম ব্যবহারকারী দেশ। বিশ্বের বৃহত্তম ট্রাম নেটওয়ার্ক বার্লিনে অবস্থিত। ট্রামকে এখানে Straßenbahn বলে। এছাড়াও চার্লোট্টেনবার্গ প্রাসাদ, বার্লিন ক্যাথিড্রাল, রাইখস্ট্যাগ প্রাসাদ ও রোমান দেবী ভিক্টোরিয়ার ব্রোঞ্জের মূর্তি দেখে নিলাম। রাত তখন গভীর স্প্রী নদীর আলোক সজ্জিত মোরাম বিছানো পাড় ধরে সাইকেল চালিয়ে চলেছি। যে দিকে যাচ্ছি তার বিপরীতে স্রোতের টান। মোরামের মর্মর ধ্বনি ও জলের কুলুকুলু শব্দে নিজেকে একা মনে হচ্ছে না আজ। এভাবে চলতে চলতে ভোর হয়ে এলো আবছা আলোয় দিগন্ত ঘোলাটে দেখায়। পূর্ব দিকে আকাশে গোলাপী আভা ছড়িয়ে সূর্যোদয় হল স্প্রীওয়াল্ডে। স্প্রীওয়াল্ড কথাটির অর্থ হলো স্প্রী ফরেস্ট। এটি দেশের সর্ববৃহৎ অভ্যন্তরীণ বদ্বীপ। আমরা জানি বদ্বীপ শুধু নদী ও সাগরের মোহনায় দেখা যায়। এই অদ্ভুত ভূমিরূপ স্প্রী নদী দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে ব্রান্ডেনবার্গ রাজ্যের এই স্থানে। স্প্রীওয়াল্ডের অপর নাম লুবেন। স্থানীয় অপর একটি শহর হল কোটবাস। কিন্তু থাকার জন্য আমি বেছে নিলাম লিপে গ্রামটিকে। ১৯৯১ সালে বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ এর মর্যাদা পাওয়া এই জলাভূমির আয়তন ৪৭৫০০ হেক্টর। শেষ তুষার যুগের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে এই অঞ্চল। লুবেন থেকে এক বিশেষ ধরনের নৌকোয় করে যাত্রা করলাম। এই নৌকো গুলির নিচটা সমতল যা স্বল্প জলে চলার উপযুক্ত। স্থানীয় ভাষায় এগুলিকে পান্ট বলে। একজন স্থানীয় পান্টার পান্টিং করে আমাকে পৌঁছে দিলো লিপে গ্রামে। একে কেন কেনোইস্টদের স্বর্গরাজ্য বলে তা বুঝলাম। স্প্রীওয়াল্ডে ঘুরতে হলে এই পান্টগুলোই ভরসা। এ বিশাল অঞ্চলটিতে কোন রাস্তা নেই। প্রতিটি শহর বা গ্রাম ক্যানেল দিয়ে জলপথে যুক্ত। আমিও একটি পান্ট বা কায়াক ভাড়া করে ভেসে পড়লাম জলে। প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে নিজস্ব কাঠের জেটি। গাঢ় সবুজ জল আশেপাশের গাছের ছায়ায় আরো গাঢ় হয়েছে। বৈঠার টানে এগিয়ে চলেছে আমার কায়াক জলের শব্দ তুলছে থেকে থেকে। অপর দিক থেকে কোন কায়াক অতিক্রম করে গেলে শব্দের প্রাবল্য যেন বেড়ে যাচ্ছে। অল্ডার ( .), বার্চ, উইলো ও ওক গাছগুলি কোথাও কোথাও একেবারে ঝুঁকে পড়েছে জলের উপর। যেখানেই বালিয়াড়ি রয়েছে পাইন গাছ গুলি মাথা তুলেছে সেখানে। নিচে পড়ে রয়েছে অজস্র পাইন কোন। দমকা হাওয়ায় শাওয়ার অব সালফার দৃশ্যমান হচ্ছে গাছের ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যকিরণে। সবুজ জলে ওক ও ম্যাপলের হলদে-লাল পাতাগুলি মোজাইকের মত রঙিন করে রেখেছে চারধার। বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে পাখিরা সচকিত হয়। প্রত্যুত্তর দেয় কিচিরমিচির করে। সিল্ট অধঃক্ষেপের ফলে সৃষ্ট বালিয়াড়িতে স্লাভীয় পদ্ধতিতে তৈরি হয়েছে কাঠের বাড়ি। একতলা-দোতলা বাড়ি চোখে পড়ল। কাঠের বাড়ি গুলি কালো, খয়েরী, পাটকেল ও গাঢ় সবুজ রঙের। চাল গুলোও কাঠের টালি নির্মিত। জানালা গুলি কাঁচের। বাড়ির সামনের ছোট জমিতে ফুটে রয়েছে নীল কর্নফ্লাওয়ার ফুল। বাগানগুলি কাঠের ফেন্সিং দিয়ে ঘেরা। একটি দ্বীপ থেকে অপর একটি দ্বীপে যাওয়ার জন্য কাঠের সিঁড়ি ও ব্রীজ রয়েছে। এখানকার মানুষ এখনও তাদের নিজস্ব ট্রাডিশন, ভাষা, সংস্কৃতি ও পরিধেয় বস্ত্রের স্বতন্ত্র রীতি ধারণ করে চলেছে। যে জলপথ গুলি দিয়ে যাচ্ছি স্থানীয় ভাষায় তাদের ফ্লিয়েজে বলে। এর অর্থ হলো প্রবাহপথ। রাস্তায় যেমন পথনির্দেশ থাকে তেমনি এই প্রবাহ পথের পাশেও পথনির্দেশ, মাইলস্টোন এবং ট্রাফিক নির্দেশ রয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে ভেসে চলতে চলতে একটু একটু খিদে পাচ্ছে। যেমনিভাবা অমনি অনতিদূরে দেখি একটি স্ন্যাকসের দোকান। দোকানের সামনের জেটিতে আমার কায়াকটিকে নোঙ্গর করলাম। চিপস ও কোকাকোলা সহযোগে আহার সেরে আবার ভেসে পড়া প্রবাহপথে।

(ক্রমশঃ)

©✍ সায়ন্তন ধর
২৭/০৮/২০২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *