~ দীপাবলীর দিনগুলো ~ বিতান গুপ্ত

~ দীপাবলীর দিনগুলো ~
বিতান গুপ্ত

কালীপুজোর আগের দিন ভূতচতুর্দশী দিয়েই শুরু হত বাঙালির দীপাবলী পালন। “ধনতেরাস!”- বিষয়টা কি ? খায়, না মাথায় দেয় ? আমাদের বাপ – ঠাকুরদাদের জানাই ছিলনা। এখন আবার অনেককেই দেখছি বিভিন্ন ধরনের POST করছেন “দিওয়ালী” লিখে। বাঙালীর “দিপাবলী”র বা “কালী মায়ের পূজার” দীপ জ্বালানোর রোশনাই তাহলে কী “দিওয়ালী”র রোশনাইয়ে ঢাকা পড়তে বসেছে ?

কার্ত্তিক মাসের লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিন থেকে যে কৃষ্ণপক্ষের শুরু হয় তার ঠিক ১৩ তম দিনের থেকে মূলতঃ দীপাবলী উৎসবের সূচনা হয় সারা ভারতে। এই ১৩ তম দিনে হয় ‘ধনতেরাস’। আর ১৪ তম দিনে পালিত হয় ‘ভূতচতুর্দশী’। দীপাবলীর সময় উত্তর ও পশ্চিম ভারতে লক্ষ্মীপুজোর উৎসব পালন করা হয়। বাঙলায় উৎসব হয় কালী পূজার। যাইহোক, ঠিক দুইদিন আগে ধনতেরাস বা ধনত্রয়োদশী পালিত হয়। ভক্তদের বিশ্বাস বিশেষ এই দিনটিতে দেবী লক্ষ্মী ভক্তদের ঘরে ঘরে যান ও তাঁদের ইচ্ছাপূরণ করেন। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কাছে এই দিনটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই এই দিনে দামি ধাতু কেনেন। সাথে ধনসম্পদের দেবতা কুবের দেবও পূজিত হয়ে থাকেন।

ভারতবর্ষের উত্তর ও পশ্চিম অঞ্চলে ‘ধনতেরাস’ দিয়েই দেওয়ালির সূচনা হয়, যা বাংলায় আমরা “দীপাবলী” উৎসব বলি।

‘ধনতেরাস’ শব্দটির সাথে ‘ধন’ কথাটি আছে বলেই লক্ষ্মীপুজো ও সাথে সোনাদানা বা মূল্যবান বস্ত্ত কিনতে হবে এমন কিন্তু নয়।

ভারত সরকারের যোগ-বিদ্যা, আয়ুর্বেদ, নেচারোপ্যাথি, ইউনানি, সিদ্ধ এবং হোমিওপ্যাথি মন্ত্রক যা আয়ুস ( Ministry of Ayush ) এই দিনটিকে ‘জাতীয় আয়ুর্বেদ দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে ২৮ অক্টোবর, ২০১৬ সাল থেকে। এর কারন ভিন্ন। এক পৌরাণিক ব্যাখ্যাও আছে এর পিছনে।
জেনে রাখুন ধনত্রয়োদশীতে নিয়মমাফিক পূজিত হতেন ধন্বন্তরী নামক দেব বৈদ্য। ভারতীয় পুরাণ শাস্ত্রমতে আয়ুর্বেদের এই বৈদ্য দেবতা, যিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতিতে। সুতরাং ‘ধনতেরাস’ শব্দটির মানে ধন বা মূল্যবান বস্তু কেনা নয়। সুপ্রাচীন হিন্দু পুরাণ মতে সমুদ্র মন্থনের সময় উঠে আসেন ধন্বন্তরী বৈদ্য। তাঁর এক হাতে ছিল অমৃতের পূর্ণ কলস, অন্য হাতে ছিল আয়ুর্বেদের বই। এই দেব বৈদ্যর সম্মানার্থেই ভারত সরকার এই দিনটি পালনীয় বলে ‘আয়ুর্বেদ দিবস’ ঘোষনা করেছেন।

মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে উল্লেখযোগ্য ভাবে লক্ষ্য করছি সোনার দোকান থেকে বাসনের দোকানে প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকে বাঙালীরা ভিড় জমাচ্ছেন – দেখে অবাক আমার মতো অনেকেই। ধনতেরাসের এই রোশনাই বাঙালীর “ভূত চতুর্দশী”র চৌদ্দ প্রদীপ জ্বালানো , চৌদ্দ শাক খাওয়া এইসব উৎসবের মাঝে অনভিপ্রেত ঠেকছে। প্রবীণ বঙ্গবাসীদের মধ্যে বিস্ময়ের উদ্রেক করছে।

কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যায় হয় কালী পুজো। আর তার আগের দিন যে চতুর্দশী‚ তাকে বলে ভূতচতুর্দশী।ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি সব বাঙালী বাড়িতে দুটো রীতি খুব মানা হতো “ভূতচতুর্দশী” রাতে জ্বালানো হতো ১৪ প্রদীপ। তার আগে সেইদিনই দুপুরে ভাতের সঙ্গে আয়োজন হতো ১৪ রকম শাক এনে ভাজা খাওয়ার। এটি কার্ত্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের শেষে চতুর্দশীতে অবশ্য পালনীয়। মনে করা হয়, এদিন গৃহস্থে প্রেতশক্তির প্রবেশ ঘটে। তাই বাংলার প্রতিটি ঘরে প্রেতাত্মা তাড়াতে ১৪ টি প্রদীপ দিয়ে সাজানো হয়। ঘরের সংলগ্ন প্রতিটি কোনে রাখা হয় প্রদীপ। যেহেতু চতুর্দশীর রাত তাই সংখ্যায় ১৪ টি প্রদীপ দেওয়া হয় রীতি মেনে। মনে করা হয় ,এই দিনে বংশের পূর্বপুরুষদের আত্মাও গৃহস্থে আসে। পরিবারের সুখ শান্তির জন্যেও তেনারা আশীর্বাদও করে যান। পূর্ববর্তী ১৪ পুরুষকে স্মরণ করে তাই ১৪ প্রদীপ জ্বালানো হয় বলেও একটি ‘মত’ প্রচলিত রয়েছে।

তবে ১৪ শাক খাওয়া ও ১৪ প্রদীপ জ্বালানোর পিছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। বৈজ্ঞানিক মতে, ঋতু পরিবর্তনের জন্য এই সময় নানা ধরনের অসুখ হয়ে থাকে। ১৪ শাক খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।মরসুম বদলের সময় প্রধানত শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতেই ১৪টি শাক খাওয়া দরকার। অন্তত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাতে বিষয়টি তাই দাঁড়ায়। যথা : বিভিন্ন ধরনের ডাটার শাক ,সর্ষে , নিম, পলতা, গুলঞ্চ, সজনে,শুষণী, লাউ কুমড়োর পাতাও মিশিয়ে নেন অনেকেই। শরীর নিরোগ রাখতে শাক সব্জীপত্রের বিকল্প অন্য কিছুই হতে পারে না।আমাদের সকলেরই এই বিষয়টা অজানা নয়। ভারতবর্ষের প্রাচীন আয়ুর্বেদ, ইউনানি এবং কবিরাজি শাস্ত্রে এই শাকগুলির নানাবিধ গুণাবলীর কথা পাওয়া যায়। বর্তমান প্রজন্মের একটা বড় অংশ এসব প্রচলিত নিয়ম কানুন মানতে চায়না।
আবার লক্ষ্য করা যায় হেমন্তের শুরুতে পোকা মাকরের ভীষন উপদ্রব হয়। এও মনে করা হয় পোকার উপদ্রবের হাত থেকে বাঁচতেও বাড়িতে ১৪ প্রদীপ জ্বালানো হয়।
ভূতচতুর্দশী পালনের পরের দিনই আসে দীপান্বিতা অমাবস্যা। মহাশক্তির আরাধনার দিন। হিন্দু শাস্ত্রমতে পঞ্চভূত বলতে বোঝায় – আকাশ, ভূমি, জল , অনল , পবন – মৃত্যুর পরে শরীর দাহ হলেই এই পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। তাই প্রথামাফিক দীপান্বিতা অমাবস্যার পূর্বেই আগের দিন শরীরকে নশ্বর জ্ঞান করে ১৪ শাক খাওয়া হয় ও সন্ধ্যায় ১৪ প্রদীপ ঘর সংলগ্ন বিভিন্ন কোনে জ্বালানো হয়।

বিদেশে পশ্চিমের দেশগুলোতে “হ্যালোইন উৎসব” পালিত হয়। ‘বনফায়ার’ বা অগ্ন্যুৎসব, আজব পোষাক পরিহিত হয়ে, ভৌতিক স্থানে ভ্রমনে গিয়ে, বা মশাল জ্বেলে ভীতিজনক আচার আচরণ করে এই উৎসব পালিত হয়। আইরিশ ও স্কটিশ অভিবাসীরা ১৯শ শতকে এই ঐতিহ্য উত্তর আমেরিকাতে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলিও ‘হ্যালোইন’উদযাপন করা শুরু করে। এই উৎসবে আরো যে বিষয়টি করা হয় তাহলো একটি বড়ো মিষ্টি কুমড়া একপাশ থেকে কেটে তার ভিতরের অংশ বের করে নেওয়া হয়। মিষ্টি কুমড়োর গায়ে চোখ,নাক,মুখ চিত্রিত করা হয় এবং একটি বাতি ভিতরে জ্বালিয়ে রাখা হয়। মনে করা হয় এইটি করলে প্রেতাত্মা বা অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
সে যাইহোক , পশ্চিমী দেশের “হ্যালুয়িন” মোটেই আমাদের মা কালীর পূজার জাকজমকের সমতুল্য নয়। আমাদের এই আলোর উৎসবের মূল লক্ষ্য হলো অন্ধকার দূরিভূত করা, যা কিছু খারাপ আলোর রোশনাইয়ে তা আমাদের মন থেকে মুছে যাবে – আমাদের অজান্তেই যে অজ্ঞানতা আমাদের মধ্যে বিরাজমান তা দীপশিখার উজ্জ্বলতায় ম্লান হয়ে যাবে, নতুন আলোয় অন্তরের অন্ধকার দূর করে আমরা সুদূরের প্রয়াসী হবো।
মহাকালী মাকালী শক্তিরূপিনী অভয়দায়িনী মা আমাদের সকলের মঙ্গল করুন। শুভ দীপাবলী ।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *