কথা দিয়েছিলে

ধারাবাহিক উপন্যাস
কথা দিয়েছিলে
পর্ব দুই

তনুকা বাপের বাড়ি বাচ্চা নিয়ে ঢুকতেই মা বলল–কোনো খবর না দিয়ে এলি যে।জামাই আসেনি?তোর কোলে ওটা কি?তনু বলল–সব বলব মা।আগে একটু বসতে দেবে তো?আমার কোলে আমার মেয়ে তিতলি।বাবা বেরিয়ে এসে বলল–হ্যাঁ রে মামণি তুই তো আমাদের বিরাট সারপ্রাইজ দিলি?তোর বাচ্চা পেটে আসার কথা একবারও তো বলিস নি।সবটা জামাই সামলাতে পারল?মাকে ডাকলেই তো পারতিস।নাতনির তো রাজকন্যার মতো চেহারা হয়েছে।তনু বলল–মা আগে একটু গরম জল করে দাও।আমি হাত পা ধুয়ে চেঞ্জ করে আগে তিতলিকে খাওয়াই।

মা বলল–কেন বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াস না?এইটুকু বাচ্চাকে এখন থেকেই ফিডিং বোতলে দুধ খাওয়ানো কি ভালো?তনু কোনো উত্তর না দিয়ে তিতলিকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল।

তনু স্বস্ত হয়ে বসে বলল–মা তিতলিকে আমি বেড়াতে গিয়ে কুড়িয়ে পেয়েছি।–কুড়িয়ে পেয়েছিস?কার না কার অবৈধ বাচ্চাকে একেবারে বুকে করে তুলে নিয়ে এলি?কেন তোর বাচ্চা হবার বয়েস কি চলে গেছে?ডাক্তার তো বলেছিলেন তোদের দুজনেরই কোনো সমস্যা নেই।কারো কারো বাচ্চা দশ বারো বছর পরেও হয়।তনু বলল–মা একটা সত্যি কথা শুনে রাখো আমি কোনোদিনই মা হতে পারব না।আমি কষ্ট পাব বলে দীপ মিথ্যে বলেছে।আর একটা কথা সম্পর্ক অবৈধ হয়।কিন্তু বাচ্চা কখনও অবৈধ হয় না।পৃথিবীর সব বাচ্চা দেবশিশুর মতো পবিত্র।স্বয়ং যিশু খ্রিষ্ট কুমারি মায়ের সন্তান ছিলেন।একটা বাচ্চার ক্ষেত্রে জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো একথা একশোভাগ প্রযোজ্য।

বাবা বলল–একদম ঠিক কথা বলেছিস মা।কিন্তু বাচ্চাটাকে আইনের সাহায্যে দত্তক নিলেই তো পারতিস।তনু বলল–বাবা আমার বহুদিনের সাধ ছিল আমি মাতৃত্বকে তিলতিল করে অনুভব করে একটা বাচ্চার জন্ম দেব।সেটা বোধহয় ভগবানের ইচ্ছা ছিল না।দত্তক নিলে পরে সবাই জানতে পারবে।আমি এটা চাইনা বাবা।সবাই জানুক তিতলি আমার গর্ভজাত সন্তান।এটা আমরা চারজন ছাড়া পৃথিবীর কেউ জানবে না।তুমি শুধু বাচ্চা বাড়িতে জন্মেছে বলে একটা বার্থ সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করো।বাবা পারবে না?–তুই যাতে ভালো থাকিস সেটা আমি করব।কিন্তু মিথ্যে দিয়ে বাচ্চাটার জীবন শুরু করা কি ঠিক হবে মা?–বাবা আমি তো কোনো অধর্ম বা পাপ কিছু করছি না। তাছাড়া কোনো অনাথ আশ্রমের সংগে যোগাযোগ করে আইন মেনে বাচ্চা এডপ্ট ও করছিনা।তিতলি কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে জানলে সবাই কেমন অনুকম্পার চোখে তাকাবে।আর এটা খুব তাড়াতাড়ি জানজানি হয়ে গেলে তিতলির শিশুমনে একটা মানসিক চাপ তৈরি হবে—বেশ মা তাই হবে।

ছমাস পর তনু তিতলিকে নিয়ে দুর্গাপুরের কোয়ার্টারে এল।দ্বৈপায়ন আগে থেকেই একটা আয়ার ব্যবস্থা করেছিল,দোলনা ও বাচ্চার প্রয়োজনীয় সব জিনিস কিনে রেখেছিল।তনু হাসিমুখে বলল–তুমি তো দেখছি বেশ দায়িত্ববান বাবা।কি সুন্দর সব গুছিয়ে ব্যবস্থা করে রেখেছো।এই দীপ তোমার মুখটা এমন গম্ভীর কেন?তিতলিকে দেখে তুমি খুশি হওনি?

দ্বৈপায়ন বলল–তুমি মিথ্যে দিয়ে নতুন জীবন শুরু করছ জেনে মনের মধ্যে কোথাও যেন একটা কাঁটা খচখচ করে বিঁধছে।তনু বলল–তুমি কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছিলে।দ্বৈপায়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল –আমার কথা আমি রাখব তনু।

বিকেল হতেই কোয়ার্টারের সবাই তিতলিকে দেখতে এল।তার মধ্যে খুব ঘনিষ্ট পাশের কোয়ার্টারের অর্কর মা মন্দিরা দি আর অর্জুনের মা মিতুল এল।ওরা সমস্বরে বলল– ওমা! কি সুন্দর ফুটফুটে ডল পুতুলের মতো মেয়ে গো।তনু তুমি তো বেশ ডুবে ডুবে জল খেতে জানো।আমরা বলতাম না অনেকের একটু দেরিতে বাচ্চা হয়।তোমাকে দেখে একদম বুঝতেই পারিনি।এবার তো অর্ক আর অর্জুনকে ঘরেই রাখা যাবেনা।মেয়ের কি মুখে ভাত দিয়ে নিয়ে এলে?আমরা কিন্তু শুনব না।আমাদের খাওয়াতে হবে।

তনু বলল–নাগো,ওর সাত মাস বয়স তো একমাস পরে।তোমাদের বাদ দিয়ে কি অন্নপ্রাশন করতে পারি?
অর্ক আর অর্জুন এতক্ষণ হাঁ করে পুঁচকে মেয়েটাকে দেখছিল।ওরা বলল–কাম্মা ও আমাদের কে হয়?ও কবে আমাদের সংগে খেলতে পারবে?ও কথা বলছে না কেন?তুমি কি আমাদের আর ভালোবাসবে
না?তনু খিলখিল করে হেসে বলল–ওমা তোরা তো আমার আগে রে?তোদের তিনজনকেই আমি খুব ভালোবাসবো।আর তিতলি তোদের দুজনেরই বন্ধু।ও তো এখনও খুব ছোট্ট তাই কথা বলতে পারছে না।একটু বড় হলেই তোদের সংগে খেলবে।

তিতলির জন্মের মিথ্যে খবর দ্বৈপায়ন তার বর্ধমানে থাকা বাবা মাকে ও জানিয়েছিল।তারাও আকাশ থেকে পড়ার মতো আশ্চর্য হয়ে বলেছিল–সেকি রে দীপু!এতবড় সুখবরটার আগে পরে কিছু জানালি না?ফোনে এত খোঁজ খবর রাখিস।তনু ও ঘনঘন ফোন করত।শুধু এই খবরটা বেমালুম চেপে গেলি?আমিও তো কত ঠাকুর দেবতার মানত করেছিলাম।আমরা কি এতটাই পর হয়ে গেলাম বাবা।নিশ্চয়ই তোর শ্বশুরবাড়ির সবাইকে জানিয়েছিলি?আর সেখান থেকেই বাচ্চা হয়েছে।

দ্বৈপায়ন বলল–মা বাবা তোমাদের রাগ করাটাই স্বাভাবিক।শুধুর তনুর নিষেধেই জানাইনি।ওর বাবা মা ছাড়া এখানকার ও কাউকে বলিনি।আর বাচ্চাটা ওর বাপের থেকেই হয়েছে।আসলে মা তনু ডাক্তারের কথাতে ঠিক ভরসা পায়নি।ওকে একদম পুরোপুরি ডাক্তার বাবু বেড রেষ্টে থাকতে বলেছিলেন।ও সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে পারবে না কি বাচ্চাটা তার আগেই মিসক্যারেজ হয়ে যাবে বলে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিল। তাই ভেবেছিল সুস্থ সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর তোমাদের সারপ্রাইজ দেবে।মা তিতলির অন্নপ্রাশনটা এখানেই দেব ঠিক করেছি।তোমরা কয়েকটা দিন আগেই চলে আসবে।

মা বলল–আমরা খুব খুশি হয়েছি বাবা। ঠাকুর দেবতাকে ডাকা সার্থক হয়েছে।ভগবান দেরিতে হলেও বংশধর দিয়েছেন। তা হ্যাঁ রে দীপু নাতনি তার বাপের জন্মভিটে দেখবে না?ওর তো শিকড় এখানেই। অন্নপ্রাশনটা এখানে হলে ভালো হত না?দ্বৈপায়ন বলল–অবশ্যই দেখবে মা।আর ওর এক বছরের জন্মদিন ওখানেই ধুমধাম করে হবে।

নির্দিষ্ট দিনে অন্নপ্রাশন মিটে গেলে তনুর বাবা মা,তার বাবা মা সবাই ফিরে গেল।তিতলি আস্তে আস্তে বড় হতে থাকল।অর্ক আর অর্জুন দিনের বেশিরভাগ সময় এখানেই পড়ে থাকত।ওর হাসি দেখে ওরা হাততালি দিত।একটু কাঁদলে ব্যস্ত হয়ে পড়ত।তিতলি ওদের কাছে একটা নতুন খেলনা ছিল।

এভাবেই একদিন তিতলির স্কুলে ভর্তির সময় হয়ে গেল।অর্ক আর অর্জুনের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হবার জন্য তিতলির বায়নাতে ওখানেই ভর্তি করতে হল। তিন বালক বালিকা এখন হরিহর আত্মা। অর্ক আর অর্জুনের বাড়িতেও তিতলির অবাধ যাতায়াত।একদিন অর্কর মা বলল–এই তিতলি তুই অর্ক আর অর্জুনকে নাম ধরে ডাকিস কেন?ওরা তো তোর বড়।এবার থেকে দাদা বলে ডাকবি কেমন?তিতলি বলল–মা যে বলেছে অর্ক আর অর্জুন আমার বন্ধু।বন্ধুকে কেউ দাদা বলে ডাকে?–তাই?ওরে বাবা এটা তো জানতাম না?পাকা বুড়ি একটা।

তিন বালক বালিকা আস্তে কিশোর কিশোরী হয়ে উঠল।তাদের অনাবিল বন্ধুত্ব দিনে দিনে বাড়তে লাগল।একদিন ঝমঝমে বৃষ্টির সময় তনু রান্নাঘরে ছিল।ওখান থেকেই বলল– অর্ক অর্জুন আজ খিঁচুড়ি ইলিশ মাছ ভাজা,বেগুন ভাজা আর ইলিশ ভাপা করছি।তোরা এখানে খাবি।আমি তোর মাদের ফোন করে দিচ্ছি। অর্ক বলল –এই আজ বৃষ্টিতে ভিজবি?কাম্মা টের পাবে না। ঝমঝমে বৃষ্টিতে তিতলিদের বাড়ির উঠোনে ওরা মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল।অনেকক্ষণ ওদের সারা শব্দ না পেয়ে তনু বেরিয়ে এসে বলল–ওমা!তোদের নিয়ে আমি কি করি বলতো?একটু অন্যমনস্ক হয়েছি কি ওমনি বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করেছিস? ঠান্ডা লেগে এক্ষুনি হাঁচি কাশি শুরু হয়ে যাবে।শীঘ্রি উঠে আয় বলছি।

বিকেল বেলা থেকে তিতলির ধুম জ্বর।অর্ক অর্জুন খেলতে যাবে বলে তিতলিকে ডাকতে এসে দ্যাখে তিতলি বিছানায় শুয়ে। আর কাম্মা তিতলির কপালে জলপটি দিচ্ছে। ওদের খুব মন খারাপ হয়ে গেল।তিতলির একটুতেই ঠান্ডা লাগার ধাত জেনেও ওকে বৃষ্টিতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।কাঁচুমাচু মুখে বলল– কাম্মা তিতলির কি খুব জ্বর? কাকু কি ডাক্তার ডাকতে গেছে?

তনু বলল–হ্যাঁ রে সোনা।ও ডাক্তার ডাকতে গেছে।অর্জুন বলল–আমি জলপটি দিয়ে দিচ্ছি কাম্মা।অর্ক বলল–আমরা আজ রাতে এখানে থাকব।আমাদের জন্যই তিতলির জ্বর এসেছে।তনু বলল–দুর পাগল,তোরা থেকে কি করবি?অর্জুন বলল–আমরা সারা রাত জেগে তিতলিকে পাহারা দেব।ঠিক সময়ে ওষুধ খাওয়াবো,কপালে জলপটি দেব।আমরা কিছুতেই আজ বাড়ি যাব না। তুমি আমাদের বাড়িতে ফোন করে দাও।

তনু বলল সে নাহয় দিচ্ছি।কিন্তু তোদের পড়াশোনা?–আমরা বই নিয়ে এখানেই পড়ব।দ্বৈপায়ন ডাক্তার ডেকে আনলে ডাক্তার বাবু বললেন–চিন্তার কোনো কারণ নেই।ঠান্ডা লেগে জ্বর।শুধু দুঘন্টা অন্তর টেম্পারেচারটা নোট করে রাখবেন।আর ওষুধগুলো ঠিক টাইমে খাওয়াবেন।

ডাক্তার বাবু চলে গেলে তনু বলল–দুই পাগলের কান্ড শুনেছো?ওরা নাকি সারারাত জাগবে।দ্বৈপায়ন বলল–সত্যি ওদের বন্ধুত্ব আর উদ্বিগ্নতা দেখে আমারই হিংসে হচ্ছে। ওরা ছেলেমানুষ,হয়তো ওরা ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়বে।কিন্তু এতবড় কথা বলেছে তো?এই বন্ধুত্ব বড় হয়ে টিকবে তো?
চলবে–

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *