তীর্থের পথে পথে — হরিদ্বার কোয়েলী ঘোষ

তীর্থের পথে পথে — হরিদ্বার

কোয়েলী ঘোষ

খুব ভোর বেলা ঘুম ভাঙল স্তোত্র পাঠ , ঘণ্টার আওয়াজে। ঘোরের মধ্যে ভাবছি এ কোথায় এলাম ? তারপর মনে পড়ল এ তো হরিদ্বার , পবিত্র পূণ্য ভূমি । উপাসনা ট্রেনে আমরা গত কাল এসেছি এখানে । হর কি পৌড়ী ঘাটের কাছেই এক হোটেলে উঠেছি ।
গায়ে চাদর জড়িয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখনও অন্ধকার কাটে নি । আবছা আলো ছড়িয়ে পড়েছে । চারিদিকে অপূর্ব এক সঙ্গীত সুধা মনে এক অন্য অনুভূতির সঞ্চার করেছে।


সামনে কুলকুল বয়ে চলেছে মা গঙ্গার নির্মল ধারা। তখনই চোখ পড়ল নিচের দিকে । অগণিত মানুষ কম্বল মুড়ি দিয়ে গঙ্গার ধারে ঘুমিয়ে আছে । এরা কারা ? এত ঠান্ডায় বাইরে কেন ? প্রশ্ন করতে ঘরে এসে দেখি সে তৈরি স্নানের জন্য । তাড়াতাড়ি আমিও তৈরি হয়ে নিলাম । পাশের ঘরে বন্ধুদের ডাকাডাকি হল কিন্তু কোন সাড়া নেই ।


নিচে হোটেলের কেয়ার টেকার বললেন – আজ এক বিশেষ তিথি । এইদিন নানা রাজ্য থেকে অনেক মানুষ আসেন স্নান করে পুজো দিতে। সারারাত তারা এই খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে ছিল । এ যেন এক একাত্মতার মেলবন্ধন । ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে ছুটে আসেন । ঈশ্বর এমনই এক অনুভব , উপলব্ধি , আজন্ম লালিত বিশ্বাস যা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না ।

হোটেলের সামনে গঙ্গা নদী বয়ে চলেছে তীব্র স্রোতে । মা গঙ্গাকে প্রণাম করে ,তারপর লোহার শিকল ধরে আস্তে আস্তে ডুব দিই । কনকনে ঠাণ্ডা জল শরীর মন ধুইয়ে দিচ্ছে পুণ্য তোয়া ভাগীরথী ।

স্নান সেরে হোটেলে এসে ভেজা জামাকাপড় ছেড়ে আবার নিচে নামি । গঙ্গার ঘাটের ধারে পাতার ঠোঙায় স্থানীয় মহিলারা ঘোমটা মাথায় ফুল , প্রদীপ , ধূপ বিক্রি করছেন । তাদের কাছে ফুল , কিনে মন্দিরের দিকে এগিয়ে চলি ।

শত সহস্র বছরের প্রাচীন গঙ্গার দক্ষিণ তটে অবস্থিত এই তীর্থক্ষেত্র । পাহাড়ের পথ বেয়ে গঙ্গা এখানে সমতলে অবতীর্ণ হয়ে চলেছে মোহনার দিকে । স্কন্দ পুরাণে এই স্থানের নাম ছিল মায়াপুরী । হরিদ্বার অর্থাৎ হরি , বিষ্ণুর দ্বার । আবার হর অর্থাৎ শিবের নাম অনুসারে হরদ্বারও বলা হয় । আবার গঙ্গার সমতলে যাত্রা শুরু বলে গঙ্গা দ্বার বলা হয় । কেউ বলেন মোক্ষ দ্বার ।
এখান থেকেই পঞ্চ পাণ্ডব মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা শুরু করেন ।
হরিদ্বারের সর্বত্র প্রাচীন মন্দির , আশ্রম দেখা যায় । এখানে ছড়িয়ে আছে নানা পৌরাণিক কাহিনী , ইতিহাস ।
হর কি পৌড়ি ঘাটে প্রচুর ভক্ত স্নান করছেন । মহাকাল মন্দির , বাল্মীকি মন্দির , শঙ্করাচার্য মন্দির , গঙ্গা মাতার মন্দির … সব
মন্দিরে দর্শন পুজো দেওয়া হল ।


ফেরার পথে দেখি মহিলারা সারি সারি গরীব মানুষদের অন্ন খাওয়াতে ব্যস্ত । অন্নদান শ্রেষ্ঠ দান । মনে মনে ভাবছি আমি কেমন করে খাওয়াই ? তখনই এক অলৌকিক ঘটনা ঘটল । পথে দেখা হল বন্ধু আর বন্ধু পত্নী র সাথে ।
আমরা জলখাবার খেতে বাজারের পথে চলেছিলাম । পিছন থেকে এক সাধু এসে বললেন – মা জি কুছ খিলাও না । আমি মনে মনে তাই চাইছিলাম । পাশে সারি সারি দোকান । একটি দোকান ঢুকে কিছু টাকা দিয়ে সাধু বাবাকে হিন্দিতে বললাম – বাবা , আপনি দোকান থেকে চাল ডাল কিনে নিন । রান্না করে নেবেন ।
তিনি স্মিত হেসে বললেন – মা জি , আপকা মনোবাসনা পূরন হুয়া না ? আমি শিহরিত , আমার মনের কথা ইনি জেনে ফেলেছেন ।
করজোড়ে প্রণাম করলাম । তিনি বললেন – মা জি আপ যাইয়ে , সব লোগ ইন্তেজার কর রহা হ্যায় । তাড়াতাড়ি পা চালাই ।
বাজারে সারি সারি দোকান । কত কি না বিক্রি হ্ছে । মিষ্টির দোকানে বড় বড় লাড্ডু দেখা যাচ্ছে । নানা পুজোর সামগ্রী আর কম্বল , টুপি , সোয়েটার ইত্যাদি । এখানে দর করার দরকার নেই । জিনিস খুব সস্তা আর মানুষ খুব সৎ । অল্প কিছু কেনাকাটি করলাম বাড়ির মানুষদের জন্য । বন্ধু প্রচুর কম্বল , সোয়েটার কেনাকাটি করলেন ।
দোকানে পুরী আর ছোলার সবজি খেলাম । খাওয়ার পর অটো ভাড়া করে এসে পৌঁছলাম মনসা মন্দিরের কাছে । সিঁড়ি দিয়ে ওঠা যায় জঙ্গলের পথ দিয়ে কিন্তু একশো সত্তর সিঁড়ি ওঠা কষ্টকর ।
আর একটি পথ রোপওয়ে । রোপওয়ে করে ওঠার জন্য অপেক্ষা করতে হলো কিছুক্ষণ ।

মনসা মন্দির
শিবালিক পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এই মনসা মন্দির তিন কিলোমিটার দূরে । রোপওয়ে থেকে উঠতে উঠতে এই পাহাড়ে উঠতে খুব ভালো লাগছিল । আর নেমে এক অপূর্ব স্বর্গীয় দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলাম ।
চারিদিকে সবুজ অরণ্য ঘেরা পাহাড় , নিচে হরিদ্বারের ছোট ছোট ঘর বাড়ি , আর বয়ে চলা বিস্তৃত গঙ্গা নদী । এই অপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতে মন এক অনাস্বাদিত আনন্দে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল ।
প্রচুর হনুমান আছে এখানে । মানুষ তাদের হাতে কলা , ছোলা দিচ্ছে । সারি সারি দোকানে পুজোর সামগ্রী গয়না , সিঁদুর বিক্রি হচ্ছে ।
পাহাড়ের ওপর একদিকে মনসা মন্দির অন্যদিকে চণ্ডী দেবীর মন্দির ।
মাকে দর্শন করে , প্রণাম জানিয়ে আমরা চণ্ডী দেবীর মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম ।

চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *