আমার ইছামতী, আমার ইচ্ছা- মতী কলমে #শ্বেতা ব্যানার্জী

আমার ইছামতী, আমার ইচ্ছা- মতী
কলমে #শ্বেতা ব্যানার্জী

” যখন যেমন মনে করি
তাই হ’তে পাই যদি
আমি তবে একখানি হই
ইছামতী নদী”( কবিগুরু)
কবিগুরু ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন ইছামতী নদী হওয়ার।
আমার স্বপ্নের স্বাধীন ইছামতী….

…চিৎকার করে বলে, ফিরিয়ে দাও আমার রূপ, আমার উচ্ছ্বাস, আমার উদ্বেল যৌবন…
—–আজ মৃত্যু পথযাত্রী স্রোতহারা আমি… যেন ডানা ছেঁটে উড়িয়ে দেওয়া পাখি। সারা শরীর জুড়ে অবজ্ঞার চর,সংস্কারের কোন উদ্যোগ নেই। উদ্বেগের
জীবনের জুড়ে শুধুই ইতিহাস হওয়ার ভয়—-
ধীরে ধীরে ইতিহাসের গহবরে হারিয়ে যেতে বসেছে আমার ইছামতী…।
একসময় এই নদী ছিল জীবনের জীবনরেখা। আজ কোথাও বা চর হয়ে নিয়েছে রাস্তার রূপ।কোথাও বা
কচুরিপানার আচ্ছাদনে মুখ ঢেকে রাখা। আজ আমি স্বপ্নের আতুর ঘরে বসে আমার প্রিয় নদীকে খুঁজে চলি..
যখন বসিরহাট ব্রিজ হয়নি নদীর বুকে হাল চষতো মাঝি, দাঁড়ের খেলায় ঢেউ উঠতো ছলাৎ ছলাৎ গরবিনী নদীর হাসির দমকে মাঝির ঘরে ভাতের ফুটে জুঁই এর গন্ধ। আজ নদীর পাড়ে পরে থাকে মরা কাকের মতন কয়েকটি নৌকা। যদিও বা কিছু নৌকা চলে তাও হাতেগোনা।

বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার মুন্সিগঞ্জের পদ্মা থেকে মাথাভাঙার সৃষ্টি আর নদীয়ার কৃষ্ণগঞ্জের মাথাভাঙা থেকে ইছামতির…..
….. আজ যেনো স্বপ্নের মতো মনে হয় এই তো কয়েকবছর আগে সবসময় থৈথৈ করে মনের আনন্দে নেচে বেড়াতো আমার ইছামতী।
মানবজাতি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য দিনের পর দিন পরিবেশের ওপর অত্যাচার করছে নানা ভাবে। গাছ কাটা,নদীর গতিপথ রুখে দিয়ে অসৎ ব্যবসা চালানো কোনোটাতেই পিছিয়ে নেই তারা। আর সেকারণে নদী হারাচ্ছে তার নাব্যতা। পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্টের পথে।
শুধুই ইছামতী! সুন্দরবনের অসংখ্য নদী আজ বিপন্নের পথে। শুধু তাই নয় এর প্রভাব সুন্দরবনের অন্য নদীগুলো সহ জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সুন্দরবনের মানুষের জনজীবন বিপর্যস্ত। পরস্পর ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা, যত ধ্বংসের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, ততই ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস সংক্রমণের তীব্রতা তীব্রভাবে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।
কী রেখে যাবো আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। নদীকে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য,পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সরকারকে। নদীর গভীরতা বাড়াতে প্রয়োজনে নদী খনন,নদীর পাড় বরাবর ম্যানগ্রোভ অরণ্য রোপণ সহ প্রয়োজনীয় সমস্তরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা খুবই প্রয়োজন।সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে দেওয়া জরুরি। নদীর নাব্যতা আসুক। পরিবেশের স্বার্থে নদী ফিরে পাক তার তার পুরনো রূপ….
* আমার ইছামতী *
বসন্তের আবেশ নিয়ে পড়ন্ত বিকেল নেমে আসে ইছামতীর কোল জুড়ে…গাছেদের আঁচলে মুখ মোছে গোধুলির আলো। সূর্যাস্তের আবেশ ছড়িয়ে পড়ে আদিগন্ত জুড়ে। সাতরঙা আলোর উৎসব ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমের আকাশে। মুগ্ধ আমি পাখিদের কলকাকলীতে সম্বিৎ হারা।
পড়ন্ত সূর্যের উষ্ণতার আবেশ আর সেঁজুতির আলো সব মিলিয়ে আমি ঈশ্বর দর্শন করি…

মাঝিরা কূলে ফেরে মাছ ধরে, কেউ আবার ডিঙা ভাসায় মাছের সন্ধানে —ছই এর ভিতর কুপি জ্বলে, হালকা বাতাসের নাড়া পেয়ে কিছু সময় দপদপিয়ে ওঠে আলোর শিখা, আমি সেখানে জীবন খুঁজি..
হালকা আবেশে সোহাগি ঢেউ তোলে ইছামতী…।
পড়ন্ত সূর্যের আদেখলাপনা ইছামতীর সারা শরীর জুড়ে…
ধূপের সুগন্ধ মেখে নেমে আসে সন্ধ্যা,
সবুজ মাঠের বুকে জ্বলে উঠে জোনাকির দীপ,
আশপাশের প্রান্তিক কৃষকদের গ্রামগুলি থেকে ভেসে আসে শঙখধ্বনি, পাশের বাড়ির গৃহস্থ বধূ
তুলসীতলায় রাখে প্রদীপ, বাঁ-হাত দিয়ে ঘোমটা টেনে সলাজ বধূ মুচকি হাসে গৃহকর্তার আগমনে।
ইছামতী বয়ে চলে আপন খেয়ালে…
শুধু স্ট্রীট লাইটের আলো ইছামতীর ঢেউয়ের উপর জীবনের উৎকর্ষ খুঁজে চলে –।
সন্ধ্যাতারা একরাশ শুভেচ্ছার ফুল পাঠায় ইছামতীর কাছে। ইছামতীর মনমরা বুকে দুলে উঠে খুশি।
আমি আপন মনে জীবনের পথ খুঁজে নদীর ঢেউ গুনি,মন পথে সহজপাঠের সুর আসে কানে।
গাছের আগায় পাখিদের ঘর গৃহস্থালির সাজ সাজ রব, কুয়াশার আচ্ছাদনে গাছেদের ঘরে মাকড়সার জাল বোনা..
আমার খেয়ালীমন দেয়ালা করে চলে বসন্তের সাথে। আজ বসন্তের উন্মদনা আমার শরীর জুড়ে । মাতাল করা পাগল হাওয়ায় আমার মন উশখুশ, আমার ইছামতীকে আগের মতন করে পাওয়ার জন্য আর ওর সাথে মূহুর্তগুলো ভাগ করে নেবার জন্য। আমি ওর প্রেমিকা হয়ে ছুটে যাই বারেবারে। তবুও সে বয়ে চলে আপন মনে আমাকে ডাক না দিয়ে —
আমার মনের দুদন্ড জিরেন নিতে একটু ভালোলাগা, একটু -আধটু ঢেউ গোনা। একটু ছুঁয়ে দেখা পরম প্রিয়রে।
বসন্তের মাতাল বাতাসে মাত্রাহীন অবুঝ সবুজ হয়ে
চেনা গন্ধ নিতে হাত বাড়াই নদীর বুকে…
অভিমানে ঠোঁট ফোলায় ঢেউ, বলে আমার খোঁজ রাখো কী কেউ?
বসন্তের আবির মেখে আবিষ্কার করি পায়ে যে বেড়ি, এপার-ওপারের খুঁজে চলা সেই ভালোবাসা মুঠো ভরে ছুঁতে চাই বসন্ত বাতাসে। আমার প্রিয় ভাইকে,
আমার ফেলে আসা মাটি, বাপ,ঠাকুরদা’র ভিটে—

আমি বলি,ইছামতী আমি একান্ত‌ই তোমার বসন্তপ্রিয়া হয়ে দিয়েছি ধরা। ইছামতি বলে আমি সকলের। একটা আস্তসূর্য দু’পারে সমান ভাগে ভাগ করে দি আমি। এক‌ই বসন্ত আসে বারেবারে আমার আদুরে ঘরে। তোরা আমাকে ছুঁয়েই ভিটের স্পর্শ নিবি।

বহু উপন্যাসে পড়া ইছামতী, আশুতোষের ইছামতী, বিভূতিভূষণের ইছামতী, রবীঠাকুরের ইছামতী। আর আমার প্রিয়সখা, ইছামতী।

বিভূতিভূষণের অপু ট্রিলজির “অপরাজিত” র শেষ পর্যায়ে ইছামতীর ধারে দাঁড়িয়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন নায়ক অপুর জন্ম, মৃত্যু, সুখ-দুঃখের মালা গাঁথা জীবনদর্শণ…….
মনে ভাবি,সন্ধ্যা আর দুঃখ বয়ে আনবেনা, আগামীর সুখ নোঙরে ফিরবে ইছামতীর বুকে এই প্রতিশ্রুতি লিখে রেখে যাবে সূর্যাস্তের উত্তাপ …
ইছামতীর উজান স্রোতে সেই শুভ বার্তা ছড়িয়ে পরবে দিকে -দিকে…।
আমার ইছামতী এমন এক আন্তঃদেশীয় নদী যা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমানা হিসাবে কাজ করে এবং গভীরভাবে বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও সাহিত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ইছামতি নদী বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও সাহিত্যে গভীরভাবে জায়গা করে নিয়েছে। মোগল শাসনকালে বিখ্যাত ‘বারো ভূঁইয়াদের’ (১২ জন স্থানীয় রাজা)একজন রাজা প্রতাপাদিত্যের সাম্রাজ্য এই নদীর পাশে অবস্থিত ছিল। বাংলার দুই বিখ্যাত সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বিভূতিভুষন বন্দোপাধ্যায় তাদের সাহিত্যে ইছামতি নদীটিকে অমর করে গেছেন । বনগাঁতে ইছামতি নদীর তীরে বিভূতিভুষনের বাড়ি ছিল এবং তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ তেও ইছামতীর নামটি তিনি বহুবার ব্যবহার করেছিলেন; পাশাপাশি ইছামতী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যতম প্রিয় নদী ছিল। রবীন্দ্রনাথ, মাঝে মধ্যেই এই নদীপথে তাঁর জমিদারি তত্ত্বাবধানের কাজে শিলাইদহ যেতেন এবং এই যাত্রাগুলির সময় তিনি অসংখ্য চিঠি, কবিতা এবং গান রচনা করেছিলেন।
এপারে টাকি ওপারে সাতক্ষীরা, মাঝে বুকে বিঁধে কাঁটাতারের বেড়া, তবুও দু’পারে দুই দেশের জেলেরাই তাদের নৌকায় নিজের দেশের জাতীয় পতাকা লাগিয়ে এই নদীপথ ব্যবহার করেন। কয়েক বছর আগে অবধিও ইছামতির মাঝখানে একসঙ্গে দুই দেশের দূর্গা প্রতিমা বিসর্জন দেওয়ার রীতি ছিল; উভয় দেশের হাজার হাজার মানুষের কাছে যা ছিল এক দর্শনীয় প্রদর্শনী ।
দুর্গাপুজোর দশমীতে বহু মানুষ জড়ো হয় দু’পারের বিসর্জনে সামিল হতে। ওপারের নৌকো বাংলাদেশের পতাকা লাগিয়ে প্রতিমা আনে নদীতে। এপারের নৌকো ভারতের পতাকা লাগিয়ে দুর্গা ভাসান যজ্ঞে মেতে ওঠে। সেদিন যেন দু’পারের কাঁটাতারের বেড়া এই ইছামতীকে কেন্দ্র করে অদৃশ্য হয় আপাতভাবে। লাগামছাড়া আনন্দে দু’পারের বাঙালীরা বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় করে। থাকেনা পাসপোর্ট-ভিসার কোন চোখ রাঙানি, মানুষ ভেসে যায় আনন্দ প্লাবনে..। আমরা ছুঁয়ে দেখি পিতৃভূমির মাটি নৌকার পাটাতনে হাত রেখে, ভাইয়ের হাতে হাত রেখে পাই সেই পুরনো ঘ্রাণ, আবেগে উদ্বেলিত বুকের হাপর,যা হাপুস নয়নের নোনাজল হয়ে নদীতে সুখ খুঁজে ফেরে।
নদী বলে, কাঁদিস কেন! দুইপাশে তোদের নিয়ে আমার বয়ে চলা…
বয়সের ভারে নাব্যতা হারিয়েছি, কিন্তু সাহস নিয়ে তোদের মিলনের পথ দেখিয়ে বয়ে চলেছি…।
সত্যিই তাই ; একটি আন্তঃদেশীয় নদী হিসেবে এমন ঘটনা পৃথিবীতে বিরল । নানান কারনে গত কয়েকবছরে এই সম্মিলিত বিসর্জনের প্রথা বেশ খানিকটা সীমিত হয়ে পড়েছে । তবুও আমার ইছামতী আমাদের মিলনায়তনে অনাবিল আনন্দের শুভেচ্ছাদূত ——।
****

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *