মৃত্যুচেতনা প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাব্যে __________ গীতশ্রী সিনহা

‘ মৃত্যুরে কে মনে রাখে ?
… মৃত্যু সেও মুছে যায় ।
যে তারা জাগিয়ে থাকে তারে লয়ে জীবনের খেলা
ভুবনের মেলা। ‘

মৃত্যুচেতনা প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাব্যে
__________

গীতশ্রী সিনহা

মৃত্যুকে নানাভাবে, নানা রঙে রঞ্জিত করেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর কাব্যে। তাঁর “প্রথমা ” কাব্যগ্রন্থ থেকে শুরু করে জীবনের অন্তিমসময়ের কবিতাতেও যা নজর পড়ে। মৃত্যু ভাবনা কখনো তাঁর কাব্যে একটি সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। জীবন ও অভিজ্ঞতার পরতে পরতে ঘটেছে বদল। নানা ঢঙে, নানা রূপে মৃত্যুভাবনা তাঁর কবিতায় উপস্থিত হয়েছে জীবনদর্শনের উৎকৃষ্ট ফসল হিসেবে। তাঁর ” প্রথমা ” কাব্যগ্রন্থে দেখি তিনি মৃত্যুকে নিয়ে অবহেলা করেছেন। মৃত্যুকে তাঁর ‘ মৃত্যুরে কে মনে রাখে ‘ কবিতাটি।কবিতাটির শুরুতেই তাঁর শ্লেষোক্তিতে যা ধরা পড়ে…..
মৃত্যুরে কে মনে রাখে?
… মৃত্যু সেও মুছে যায়।
যে তারা জাগিয়ে থাকে তারে লয়ে জীবনের খেলা
ভুবনের মেলা।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতন মৃত্যুকে নিয়ে এমন অবহেলা জীবনানন্দর কবিতাতেও আমরা পেয়েছি। বিশেষ করে তাঁর ” রূপসী বাংলা ” র কবিতাতে। তবে মৃত্যুকে জীবনানন্দ উল্টিয়ে – পালটিয়ে বহুভাবে দেখেছেন। অবহেলাও যেমন করেছেন তেমনি মৃত্যুতে কখনো আচ্ছন্ন হয়েছেন বিষাদে – হতাশায়, ঘন বেদনায়। আবার এই মৃত্যুর কাছেই খুঁজে পেয়েছেন পরিশেষে পরম প্রশান্তি। কিন্তু মার্কবাদী চেতনায় উদ্ধুদ্ধ কবি হওয়ার জন্য প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাব্যলোকের ভুবন অন্য খাতে বয়। অন্য প্রকৃতির পরিমন্ডল নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর কবি – মানসিকতার দৃষ্টিভঙ্গি। ‘ মৃত্যুরে কে মনে রাখে ‘ কবিতাটি পাঠ করলে দেখ যায়, কবি প্রেমেন্দ্র মৃত্যুর পাশ কাটিয়ে সাবলীলতায় জীবনের উদ্দাম কল কল্লোলে জানিয়েছেন তাঁর অভিপ্রেত ইচ্ছের কথা…
ওরে ম্রিয়মান কবি উঠে বোস, শোক – শয্যা তোল
বন্ধুর বিরহ – ব্যথা ভোল,
কান পেতে শোনো বসে জীবনের উন্মত্ত কল্লোল…
আকাশ বাতাস মাটি উতরোল আজি উতরোল।
অবশ্য প্রেমেন্দ্র মিত্রের চোখে জন্ম, মৃত্যু, প্রেম, আনন্দ, দুঃখ ও সুখ সবই বিধাতার তামাসা বলে মনে হয়েছে। এ কারণে তাঁর ” প্রথমা ” কাব্যে একটি বিষয় বিশেষ করে নজরে পড়ে… মর্ত্য প্রেমের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কবি মনে মৃত্যুচেতনারও অমোঘ দানা বেঁধেছিল। এ কারণে ” প্রথমা “কাব্যে একদিকে যেমন নজর পড়ে মৃত্যুকে অবহেলা করে যৌবনের জয়গান, তেমনি আবার তিনি মনে করেছেন… মৃত্যুর শাসন উপেক্ষা করা যায় না বলেই যৌবনেতে ভোগ করাই শ্রেয়। এই দ্বান্দ্বিকতায় বলা যায় তাঁর ” প্রথমা ” কাব্যগ্রন্থটি রচিত। এখানে কিছু দৃষ্টান্ত রাখছি…
১) মাটির ঢেলা, মাটির ঢেলা,
রঙ দিলে কে তোর গায়ে ?
গড়তে তোরে কোন আদলের ছাঁচে ?
ভূখ দিলে যে বুক দিলে যে
দুখ দিলে লেলিয়ে পাছে পাছে
( ‘ মাটির ঢেলা ‘, ” প্রথমা” )
২) মৃত্যু শাসায়, শুনতে কি পাস?
দেখতে কি পাস, শ্মশান পাতা সকল ঠাঁই ,
বিশ্বজুড়ে চিরটাকাল কালের হাতে নেই কামাই।
ওরে অন্ধ, ওরে হতাশ।
লুট করে নে যেথায় যা পাস,
আকাশ বাতাস ,
প্রেমের প্রকাশ,
নারীর দেহে রূপের বিকাশ,
যেথায় যা পাস।
( ‘ ইহবাদি ‘, “ঐ “)
৩) দেখি মৃত্যু শিয়রে নেওয়া চির – বিলাপের শপথ শাপ হয়ে ওঠে
শুনি বৃদ্ধ তার যৌবনের প্রেম নিয়ে পরিহাস করছে।
( ‘ সংশয় ‘, ” ঐ “)

চলবে ক্রমশ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *