টুসু পরব এবং ইতিহাস ছুঁয়ে সাহিত্য তুলি মুখার্জি চক্রবর্তী

টুসু পরব এবং ইতিহাস ছুঁয়ে সাহিত্য
তুলি মুখার্জি চক্রবর্তী

কোনও দেশের সাহিত্য ও ইতিহাসের অন্যতম ভিত সেখানকার লোক সংস্কৃতি। একটা সমাজ ব্যবস্থা ও তার বিভিন্ন নিয়ম অতীতের হাত ধরেই বর্তমান হয় আর সেটাই ইতিহাস। ইতিহাসের বিভিন্ন ধারা বিভিন্ন ভাবে প্রবাহিত হয়ে প্রভাবিত করেছে সমাজকে নানা ভাবে। সব ধারাই স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বতন্ত্র ভাবে চলে আসলেও অন্য ধারার বা অন্য নিয়মে চলা মানুষেরাও সেই সব লোক সংস্কৃতির স্বাদ সাগ্রহে আস্বাদন করে।
বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের চেতনার উন্মেষ যত হচ্ছে ততই অতীত থেকে চলে আসা সংস্কৃতি সাহিত্যেও স্থান করে নিয়েছে নিজ বৈশিষ্ট্যে।

বাংলা লোক সংস্কৃতির অন্যতম হল টুসু পরব।

টুসু নামকরণ নিয়ে মতভেদ আছে।
দীনেন্দ্রনাথ সরকারের মতে তুষ বা তিষ্যা নক্ষত্র থেকে বা ঊষা শব্দ থেকে টুসু নামকরণ হয়েছে। আবার তিনি বলেন মধ্যপ্রাচ্যের প্রজনন দেবতা টেষুব থেকে টুসু শব্দ এসেছে।
ডঃ বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতোর মতে তুষ থেকে টুসু নাম কারণ এই লৌকিক দেবীকে সাজানোর অন্যতম উপাচার ধানের তুষ।

টুসু উৎসব বাংলা অগ্রহায়ন মাসের শেষদিনে, মতান্তরে পৌষ মাসের প্রথম দিনে শুরু হয়। শেষ হয় পৌষ মাসের শেষ দিন বা মকর সংক্রান্তির পূণ্য লগ্নে টুসু দেবীকে নদী বা পুকুরে বিসর্জনের মাধ্যমে।
টুসু এক লৌকিক দেবী। এই পুজো বাংলায় সাধারণত পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বর্ধমান এবং মেদিনীপুর জেলায় এবং অন্য রাজ্যেও অনেক জেলায় হয়। কৃষি ভিত্তিক উৎসব টুসু।

টুসু উৎসব পালনের সময় পৌষ মাসের শেষ চারদিন চাঁউরি, বাঁউরি, মকর এবং আখান নামে পরিচিত। বিভিন্ন পদ্ধতিতে এই চারদিন দেবীর আরাধনা হয়। সংক্রান্তির দিন মেয়েরা দল বেঁধে গান গাইতে গাইতে মাথায় করে বা রঙিন কাগজে সাজানো বাঁশের চতুর্দোলা করে টুস দেবী কে পুকুরে বা নদীর ধারে নিয়ে যায়। সেখান প্রত্যেক টুসুদল একে অপরের টুসুর নিন্দা আর নিজের টুসুর সুনাম করে গাইতে গাইতে দেবী বিসর্জন করে।

টুসু পরবের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে টুসু গান। রোজকার জীবনের সুখ দুঃখ আনন্দ ও সামাজিক অভিজ্ঞতা কে ভিত্তি করেই সাংসারিক সহজ সরল ভাষায় মুখে মুখে বাঁধা হয় এই গান।

যেমন রাগ করে স্ত্রী স্বামীকে বলছে,

” তুই চলি যা ভাঙা সাইকলে
তুকে দেখে মোর গা জ্বলে
তুই চলি যা ভাঙা সাইকলে”

আবার বৌয়ের উদ্দেশ্যে স্বামী বলছে,
”যাব টাটা আনব আটা
রাঁধিস সুখের পরোটা”

আর্থিক অনটন থেকেই এই গান।

আবার মা গাইছে বিবাহিতা মেয়ের শ্বশুরঘরে কোদঁল করে চলে আসার পর,

”আমার টুসু রাগ করিছে
বরকে দিছে আড়ি
বাপের ঘরে রইবেক টুসু
যাবেক না বাপের বাড়ি ”

আবার টুসু গানে সামাজিক আন্দোলনের কথাও উঠে এসেছে। এই প্রসঙ্গে মানভূম ভাষা আন্দোলনের কথা মনে করা যেতে পারে শ্রী ভজহরি মাহাতোর একটি গানে।

বাংলা ভাষার দাবীতে ভাই, কোনো ভেদাভেদ নাই
এক ভারতে ভাইয়ে ভাইয়ে, মাতৃভাষার রাজ্য চাই
জন শাসন চাও যদি রে, বাংলা বই আর গতি নাই
মোদের ভূমি মানভূমেতে, গড়িব রাম রাজ্যটাই।।

এভাবেই সাহিত্য হয়ে টুসু ইতিহাসের পাতায়। বিশ্বায়ন ও দ্রুত নগরায়নের সাঁড়াশি ফাঁদেও লোক সংস্কৃতির মূল সুর বিভিন্ন পরবের মাধ্যমে ধরে রাখা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *