সুবর্ণরেখার তীরে —- কোয়েলীর সাথে

সুবর্ণরেখার তীরে

এই যাত্রা পথে কোয়েলীর সাথে

নদীটি চলেছে আপন মনে ।
অরণ্য , পাহাড় , শাল , মহুলের পথ ছুঁয়ে ছুঁয়ে
বুকে তার অজস্র কালো পাথর , শিলা
কত যুগ ধরে বয়ে চলা —
দুঃখ , কষ্ট , শোক , জলের রেখা
বালু চরে চিকচিকে অভ্র কণা ।
সূর্যের আলো পড়ে নদী করে ঝিকমিক
চাঁদের আলোয় ছড়িয়ে পড়ে মায়া ,
রোম্যান্টিক অপরূপা সে , রাতমোহনা ।
দূরে তখন পাহাড়ে বাজে ধামসা মাদল ,
সুবর্ণরেখা নাচে উচ্ছ্বাসে ,নূপুর বাজে পায়
নদী তখন ভাসায় ,ভাসিয়ে দূরে নিয়ে যায় —
ভোলায় ইতিহাস , যত অতীতকথা
আঁকেবাঁকে হারানো ছবি যেন রুপকথা ।

নদীর নাম সুবর্ণরেখা । বালি খুঁড়ে না কি সোনা পাওয়া যেত তাই এমন নাম ।
অজস্র পাথর , শিলা । শিলার বুকে সাবধানে পা রেখে নদীর মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়েছি । এখানে নদী বেশ চওড়া , পাথরের ফাঁক গলে শুভ্র ফেনায় উচ্ছ্বসিত । এ নদীর বুকে জাহাজ চলে না । মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে চলেছে । একদিকে একটি পাহাড়িয়া ঝোরা নেমেছে ।
নদীর মতই উচ্ছ্বাস সবার মনে । ছবি তুলি মোবাইলে আর সঙ্গীরাও তখন ছবি তুলতে ব্যস্ত ।

সূর্য তখন অস্তাচলে । আকাশ আর নদীর জলে মায়াবী আবীর রঙ । অদ্ভুত এক শান্ত নির্জন পরিবেশ । কিছুক্ষণ আগে জেলেরা মাছ ধরছিল ।এখন জাল গুটিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ।আমাদেরও ফিরতে হবে । মনে হল এখানে সুবর্ণরেখা র তীরে আরো কিছুক্ষণ বসা যেত কিন্তু নির্জন বলেই তাড়া দিয়েছে ।
রাতের খাবারের কথা বলা নিচের হোটেলে বলা ছিল ।গরম গরম রুটি , তরকারী , মিষ্টি খেয়ে ক্লান্ত শরীর বিছানায় দিতে না দিতেই ঘুম নামল চোখে ।

বুরুডি লেক

পরের দিন সকালে স্নান করে তৈরি হয়ে নিচে নেমে দেখি , লজের সামনে ফাঁকা জায়গায় তখন সবাই ব্যায়াম করতে শুরু করে দিয়েছে ।
তারপর লুচি ,তরকারি , চা খেয়ে রওনা দিলাম
দুটি ভাড়া গাড়িতে ।
ঘাটশিলা শহর থেকে গাড়ি ছুটল বুরুডি লেকের দিকে ,দূরত্ব নয় কিলোমিটার ।
বুরুডি যাবার পথে দেখলাম আদিবাসী গ্রাম । মহিলারা দুরের ক্যানেল থেকে জল ভরে নিয়ে আসছে , কেউ বা ছাগল ,ভেড়া চরিয়ে ঘরে ফিরছে । মাটির উনুন ,কাঠের জ্বালে রান্না করে তারা । সেই চেনা ভারতবর্ষের মুখ , এই মানুষদের চিনতে আর জানতে মাঝে মাঝেই পথ টানতে থাকে ।
দুপাশে শস্যখেত , জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে লেকের কাছাকাছি গাড়ি এসে থামল । দুদিকে সারি সারি দোকানপাট । তার মাঝে সিঁড়ি নেমে গেছে । সিঁড়ি দিয়ে নামতেই দুচোখে যেন স্বপ্ন , চিত্রপটে আঁকা চোখ জুড়ানো ছবি ।

নীল অম্বর ,নীল লেকের জল ,নীল নীল পাহাড় লেকটিকে ঘিরে আছে ।
তারই ধারে শীতের পরিযায়ী পাখিদের মেলা ।
নীল জলের আয়নায় ছড়ান সেই আনন্দ ,সেই অনিন্দ্য সুন্দরে অবগাহনে তৃপ্ত মন ।
জলে ভাসছে রঙিন বোট । কেউ কেউ উঠল বোটিং করতে ।
আমি চুপটি করে বসি লেকের ধারে , গুনগুন করি —
” বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা ।।
বাজে অসীম নভোমাঝে অনাদি রব ,
জাগে অগণ্য রবি চন্দ্র তারা ।।”

একসময় উঠে আসতে হল যদিও মন চায় না ।সিঁড়িতে এক দল বাচ্চা ছেলে ঘিরে ধরল ।
” দাও না বিস্কুট কিনে — মন ভিজে ওঠে ।
কেউ পয়সা বের করে দিল ।আমি চললাম বিস্কুটের দোকানে । পিছন পিছন তারাও চলল ।বিস্কুট কিনে হাতে দিতেই খুশিভরা চোখ । ওরা চলে গেল । আমি তাকিয়ে আছি ঘোমটা মাথায় দোকানের বউটির দিকে । সে তখন পাঁচ মিশালি তরকারীতে খুন্তি চালাচ্ছে । মাটিতে পাতা কয়লার উনুন । স্বামীটি খরিদ্দার সামলাতে ব্যস্ত । একটা ছোট বাচ্চা বসে আছে ।


বউটি হেসে বলল – কুথা থেকে এইছ দিদি ?
আমিও হেসে বলি -সেই কলকাতা ছাইড়ে– সেই গঙ্গা নদীট পার হৈয়ে —
আর তুমার ঘর কুথাকে ?
হুই জঙ্গল পেরিয়ে — অনেকট নামুতে — বলে পিছনের জঙ্গল দেখায় । গল্পে জানলাম সকাল সকাল ওরা চলে আসে এখানে ,দোকানে উনুন জ্বালে ,রান্না করে ।
আমার দুকানে খাও ক্যানে দুটি ভাত , দেশি মুরগির ঝোল রান্না করে দুব । আলুভাজা ,বেগুনভাজা —
দাঁড়াও গো ,জিগ্যেস করে আসি –
আর যেতে হল না ,পিছনেই ওরা খুঁজতে এসেছে । না ,কেউ ভাত খাবে না ।
দুটো চিপসের প্যাকেট কিনি দোকান থেকে । তারপর গাড়িতে উঠি ।
যাবার আগে ঘুরে ঘুরে দেখে নিই আদিবাসী মেয়েদের হাতের তৈরি মাটির জিনিস , কাপড়ের ব্যাগ । বুরুডি লেক বার বার টানবে , এই নির্জনতা এই প্রকৃতি শহরে অমিল ।

গাড়ি চললো ধারাগিরির পথে । পাথর কেটে পথ তৈরি হয়েছে।এই পথ খুব সুন্দর । চারিদিক সবুজ , দুধারে মাঠে মাঠে কচি ধান , জঙ্গল ।

ধারাগিরি

গাড়ি পৌঁছলো ধারাগিরি থেকে এক কিলোমিটার আগে । এখান থেকে পায়ে হাঁটা পথ । লাল মাটির রাস্তা । বাঁদিকে ছোট একটি চায়ের দোকান । চা ,বিস্কুট ,চিপস ,লজেন্স ঝুলছে । দোকানি বউটি চা দিতে ব্যস্ত । সেখানে অনেকে বসে গেল ।এক কিলোমিটার পাহাড়ি পথে তারা হাঁটতে অক্ষম । আমি আগেই পা বাড়িয়েই আছি ।
একটি বাচ্চা মেয়ে এসে বলল – আমাকে লাও কেনে .. দিখান দুব । পঞ্চাশ টাকা দিবে ।
ওরাই গাইড । লাল ফিতে বাঁধা বাচ্চা মেয়েটি চলল আমাদের সাথে । পিছন ,পিছন …চলেছি ধারাগিরির পথে ।
দুদিকে শাল ,তমাল ,পিয়াল বড় বড় বৃক্ষ ,মাঝখানে লাল মাটির পথ চলে গেছে ।এই রাঙা মাটির পথ ,এই শাল বন যেন আমার চেনা ,নেশা জাগায় চোখে ।

”রক্তে রেখে গেছে ভাষা ,
স্বপ্নে ছিল যাওয়া আসা —
…..মন যে বলে চিনি চিনি ” ……….

পাতার ফাঁক গলে কোথাও আলো ,কোথাও ছায়া মাখা পথ । চেনা অচেনা বাহারি ফুল দেখতে দেখতে চলেছি ।
তারপর পাথুরে রাস্তা , পড়ে যাবার ভয় । একটি দোকান থেকে লাঠি নিয়ে টলমল করে হাঁটছি । নিচে কোথাও জলের ধারা বয়ে চলেছে — কে কোথায় উঠে গেছে ওপরে , আমি সবসময় যাত্রীদলের পিছনে পড়ি ।
বনের পথ পেরিয়ে , পাথরের ওপর সাবধানে পা ফেলে ফেলে এগোচ্ছি এমন সময় একটি অল্প বয়সী ছেলে এসে বললো — আমার হাতটা শক্ত করে ধরুন । পড়ে যেতে পারেন ।
বাকি পথটুকু তার হাত ধরে পেরিয়ে গেলাম । ঈশ্বর এইভাবেই সাথে থাকেন । অসময়ে হাতটি বাড়িয়ে ধরেন আর নির্বিঘ্নে পার হয়ে যাই পথ ।

সারা পথ ছোট ছোট বাচ্চারা ঘিরে ধরছে — পয়সা দিয়ে যা না । একটা টাকা দিবি ?
এদের নাম ফুলমণি , মংলু , বুলবুলি —
তোদের বাড়ি কোথায় রে ?
জঙ্গলের মাঝে এক লাল মাটির রাস্তা দেখিয়ে দেয় …,হু উদিকে ।
লেখাপড়া করিস না ?
দু ক্লাসে পড়ি ।
এদের ঘরবাড়ি আমি চিনি । মাটির ঘর ।
আলোকজ্জ্বল এই আধুনিক সভ্যতার কাছে ওদের বার্তা পৌঁছে দিলাম ” একটা পয়সা দিবি ?

সেই বিপদসঙ্কুল পথ পেরিয়ে দেখা হল ঝরনার সাথে ,নাম ধারাগিরি ফলস । পাথরের ফাঁক গলে আছড়ে এসে পড়েছে নিচে পাথরের বুকে । যেন রবিঠাকুরের গান গেয়ে বলছে —
” আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো
তাই তো তোমার বাণী বাজে ঝর্না -ঝরানো ” …

কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে এই নিবিড় অরণ্যের সান্নিধ্য অনুভব করলাম । একটা গাছের নিচে পাথরের মূর্তি ” মারাং গুরু ” লাল সিঁদুর আর ফুলে সাজানো । কাছেই একটি শিব মন্দির আছে । সেখানে আর যাওয়া হয় নি ।
সেই পথ ধরে আবার ফেরা । গাড়ি চললো গালু ডির দিকে ।

চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *